হযরত নোমান ইবনে বশির রা. বলেছেন- আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি যে ইসলামে ‘হালাল-হারাম’ স্পষ্ট। এ দুটির মাঝে কতোগুলো ‘সন্দেহভাজন’ বিষয়বস্তুও আছে। সেগুলো কোন পর্যায়ে তা অধিকাংশ লোকই নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করতে পারে না। যে ব্যক্তি সে সন্দেহজনক বিষয়গুলো থেকে সংযমি হবে তারই দীন-ঈমান ইজ্জত-আবরু সুরক্ষিত থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহে লিপ্ত হবে, তার অবস্থা হবে কোনো রাখাল তার পশুপালকে (সরকারী বা কারো) সংরক্ষিত স্থানের নিকটবর্তী চরিয়ে থাকে; এমতাবস্থায় অ- সময়ের মধ্যেই তার পশুগুলো সে সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়বে (এবং তার দ্বারা রাখাল বিপদগ্রস্ত হবে। তেমনি মধ্যস্থলিয় সন্দেহযুক্ত বিষয়বস্তুগুলো থেকে যে ব্যক্তি সংযমি না হবে এবং তা থেকে দূরে না থাকবে, অচিরেই অনিবার্যভাবে তার নফস বা প্রবৃত্তি স্পষ্ট হারামে লিপ্ত হয়ে যাবে, ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে অপদস্থ হবে) তোমরা শুনে রাখ, প্রত্যেক বাদশাহর সংরক্ষিত এলাকা থাকে তেমনি আল্লাহ তায়ালার নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুসমূহই দুনিয়ার বুকে তার সংরিক্ষত এলাকা। (সেখানে কারো প্রবেশ করতে নেই, অধিকন্তু তার নিকটবর্তী হওয়া তথা সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হওয়াও উচিত নয়।
আরো শুনে রাখ মানবদেহে এমন একটি অংশ রয়েছে যে, সেই অংশটি যখন যথার্থভাবে ঠিক হয়ে যায়, তখন মানুষের পূর্ণ অস্তিত্ব ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানবদেহটিই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে সেই অংশটি যখন খারাপ হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত অস্তিত্বটিই খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ মানব দেহের কোনো অংশ বা কোনো অঙ্গই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। খুব ভালো করে জেনে নাও সে অংশটি হুে ছ মানুষের বিবেক।
বিশ্লেষণ : শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম চার প্রকার দলিল ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় । কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। এর যে কোনো একটি দ্বারা যে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ‘হালাল’ বৈধ ও গ্রহণীয় বলে প্রমাণিত হবে যে এটিই হালাল এবং যে কোনো বিষয় সুষ্পষ্টভাবে ‘হারাম’ নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বলে প্রমাণিত হবে তা হারাম।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল এবং হারাম অতি স্পষ্ট এবং এই সকল দলিল, প্রমাণ ও মাপকাঠি দ্বারা উভয়টিকে বেছে নেয়া অত্যন্ত সহজ। অধিকন্তু এটিও স্পষ্ট যে, হালালকে গ্রহণ করা যাবে এবং হারামকে বর্জন করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্রও নড়চড় করার অবকাশ নেই। কিন্তু হালাল ও হারাম পর্যায়দ্বয়ের মধ্যবর্তী আরো কিছু পর্যায় রয়েছে। যথা মাকরূহ, খেলাফেআওলা বা অবাঞ্ছনীয়, ইমাম ও খাঁটি ওলামাদের মতোবিরোধমূলক বিষয়াদি।
এতদ্ব্যতীত এমন আরো বহু বিষয়াদি আছে যা শরিয়তে লিপিবদ্ধ আছে এবং তা ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে প্রায়শই এমন বিষয়াদি আমাদের সম্মুখবর্তী হতে থাকে যা নির্দিষ্টভাবে হালাল বলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না, কিংবা হারাম বলেও স্থির করা যায় না এ সকল অনিশ্চিত ও সন্দেহভাজন বিষয়গুলোকে সযত্মে পরিহার করে চলাই একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা এ সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহ থেকে বিরত থাকলে এক দিকে জাগতিক ব্যাপারে যেমন লাভবান হওয়া যায়, কারণ সন্দেহের স্থানে পা রাখলেই স্বীয় মান-মর্যাদা কলুষিত হওয়ার এবং নানা প্রকার কুৎসা রটানোর সুযোগ উপস্থিত হয়।
অন্যদিকে তেমনি দীনের ব্যাপারেও লাভের সীমা থাকে না। কারণ যে ব্যক্তি স্বীয় নফ্স ও প্রবৃত্তিকে সন্দেহের স্থান থেকে বিরত রাখতে অভ্যস্ত হবে, সে নিশ্চয় যাবতীয় কুপ্রলোভনের বস্তু থেকে এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে স্বীয় নফ্সকে ফিরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
হারাম ও সন্দেহভাজন কাজ থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম নিজের বিবেককে যথার্থভাবে সুষ্ঠু ও ঠিক করতে হবে। কারণ মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য বৈদ্যুতিক মটর স্বরূপ। মটর ঠিকভাবে চালু থাকলে কারখানার প্রতিটি শাখা তার প্রতিটি অংশ ও সমস্ত কল-কবজার চাকাগুলো রীতিমত চলতে থাকবে। আর মটরে গোলযোগ থাকলে তার সংযোগ রক্ষাকারী সমস্ত মেশিন ও তার অংশগুলোর মধ্যেও গোলযোগ দেখা দিবে। অবশ্য মটরের সঙ্গের চাকাগুলো সক্রিয়সংযোগ রক্ষার প্রতিও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে মেশিনের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সংযোগবিহীন শুধু মটর চালালে উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং এ ধরনের নিরর্থক ও অনিয়মিত পরিচালনার ফলে কারখানা ফেল হয়ে যাবে। অতএব মেশিনের সমস্ত কল-কবজা ও তার বিভিন্ন অংশগুলোকেও রীতিমত চালু রেখে মোটরের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, তার ভাল-মন্দের প্রভাব সমস্ত কারখানার ওপর পড়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষের কর্তব্য তার বিবেক-বুদ্ধিকে সুষ্ঠু করে তার পর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেক দ্বারা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা।
দেহ আলোচনা
উপরোক্ত হাদিসের শেষ বাক্য ‘আলা ইন্নাফিল জাছাদে মুজগাতান’ মানবদেহের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ আছে যার উন্নতি-অবনতির উপর সম্পূর্ণ দেহের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে। এ তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টি তত্ত্ব ও দেহ-তত্ত্বের ইঙ্গিত দানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে, স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষè আত্মার উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মুখ্য উন্নতি নির্ভর করে। আত্মার উন্নতি সাধিত না হলে মানব জীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
মানুষের অজুদ বা অস্তিত্ব দুই ভাগে বিভক্ত স্থুলদেহ’ যা বাহ্য দষ্টিতে বা যান্ত্রিক সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে থাকে এবং ‘সূক্ষèআত্মা’ যা ঐরূপে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। মানুষের স্থুলদেহ সৃষ্টির মূলে যেমন বিভিন্ন উপাদান রয়েছে যথা পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নি তেমনি তার এ ভৌতিক দেহাভ্যন্তরে পাঁচ প্রকারের আত্মাও রয়েছে। যথা
১। পশুর আত্মা, যা দ্বারা খাওয়া শোয়া, কামরিপু চরিতার্থ করা ইত্যাদি প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়।
২। হিংস্র জীবের আত্মা : যা দ্বারা দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ ও রাগের বশীভূত হয়ে মারামারি কাটাকাটি করত: প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তি জন্মে থাকে।
৩। শয়তানের আত্মা : যার প্ররোচনায় পাপাচার, অহঙ্কার, মিথ্যা ও সূক্ষ্ম কূট-কৌশলের দ্বারা মানুষকে ধোকা দেয়া ইত্যাদির প্রবৃত্তি উদিত হয়।
৪। ফেরেশতা আত্মা : যা দ্বারা সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, সত্যতা, পরোপকারিতা ও আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করা ইত্যাদির আগ্রহ ও আকর্ষণ জন্মে থাকে।
৫। মানুষের আত্মা : যার কর্তব্য হুে ছ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আত্মাকে বশ করত: তাদেরকে কুপ্রবৃত্তির দিক থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে গুণান্বিত ও পরিচালিত করা এবং আল্লাহর মারেফত ও মহব্বত হাসিল করত: দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত তথা আল্লাহর হুকুম আহকাম জারির পরিবেশ কায়েম করার আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
প্রথম তিনটি আত্মাকেই তাসাওফের পরিভাষায় ‘নফসে আম্মারা’ বলা হয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম এ দুটিকে রূহ, আ’ক্বল বা লতিফা বলা হয় এবং এটিই হুে ছ বিবেক, বুদ্ধি ও মানবাত্মা।
দেখা গেল যে, এই পাঁচ প্রকারের আত্মাই তাসাওফের পরিভাষায় দুই নামে পরিচিত হয়েছে। একটি হল নফসে আম্মারা; এর তিনটি বিভাগ যথা পশুরআত্মা, হিংস্রজন্তুরআত্মা ও শয়তানেরআত্মা। দ্বিতীয়টি হলো রু হ অর্থাৎ মানবাত্মা বা বিবেক -আকল। এর দুটি বিভাগ যথা ফেরেশতার আত্মা ও মনুষত্বেরআত্মা।
রাসূল সা. ‘আলা ইন্না ফিল জাছাদে মোজগাতান’ বলে মানব দেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি নির্দেশ করেছেন, সে অংশটিই হুে ছ রু হ বা আকল-বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে; এটাই রাসূল সা. বলেছেন রু হ বা জ্ঞান-বিবেক রত্মটির উন্নতি হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং এর অবনতিতে সমগ্র মানবদেহের অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে, এই অংশটির উন্নতির অর্থ কী? বস্তুত প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতির বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দ্বারা। তাই এখন দেখতে হবে যে রু হ বা বিবেকের উপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। কারণ, রু হ মানবাত্মা বা বিবেক বলে যে দুটি আত্মার নামকরণ হয়েছিল অর্থাৎ ফেরেশতাআত্মা ও মনুষ্যত্বের আত্মা তাদের কর্তব্য ছিল সদাচার, সততা, সভ্যতা ও আল্লাহর বশবর্তীতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফস নামে যে অপর তিনটি শক্তি বা আত্মা আছে তাদেরকে বশে এনে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে পরিচালিত করা। অতএব রু হ বা বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তাই হবে। এ মহান কর্তব্য পালনে রু হ মানবাত্মা বা বিবেক যতোটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণমানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। এমনকি অবশেষে এই রু হ মানবাত্মা যে উর্দ্ধজগত থেকে এসেছিল পুনরায় সে মানবদেহকে নিয়ে সেই উর্দ্ধজগতে অর্থাৎ বেহেশতে গিয়ে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে রূহ মানবাত্মা নিজের ঐ কর্তব্যে ত্রু টি করত: নিজেই যদি নফস তথা ঐ তিন প্রকার আত্মার বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তা হলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির তিমির গর্তে পতিত হবে। অবশেষে ঐ রু হ মানবাত্মা মানবদেহকে নিয়ে সর্ব নিু জগতে তথা জাহান্নামে পৌঁছাবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদগণ রু হ বা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করেছেন। পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়ে ছিল যে, রু হ মানবাত্মা বা আকল ও বিবেককে তাসাওফের পরিভাষায় লতিফা নামেও নামকরণ হয়ে থাকে। সেই অনুসারেই রু হের উন্নতির পাঁচটি স্তরের নিুলিখিতরূপে নামকরণ করা হয়েছে।
১। লতিফায়েকলব : মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর নাম উু চরণ করত: জিকির করে তখন সে এ লতিফায়ে কালবের কর্তব্য পালন করে।
২। লতিফায়ে রু হ : মানুষ যখন আল্লাহর মহৎ গুণাবলীর ধ্যান করে এবং এই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যেও ঐ গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করে, যেমন : আল্লাহ দয়ালু, দয়াময় এর ধ্যান করত: এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, আমাকেও দয়ালু হতে হবে এবং দয়ালুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে তখন হয় লতিফায়ে রু হের কর্তব্য পালন।
৩। লতিফায়ে সের্র : মানুষ যখন আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিবিম্ব নিজের মধ্যে হাসিল করায় সচেষ্ট হয় তখন তার সিনার অভ্যন্তরে আল্লাহর মারেফাতের বা আল্লাহর গুণাবলীর তত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূতহয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয় অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে, এটাই হুে ছ লতিফায়ে সের্র এর কর্তব্য।
৪। লতিফায়ে খফী মানুষের মধ্যে যখন আল্লাহর মা'রেফতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভুত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণিত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয়। অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণভাবে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে। এটাই হ্ছে লতিফায়ে খফীর কর্তব্য।
৫। লতিফায়ে আখফা : মানুষ ফানা-ফিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহরগুণে গুণান্বিত হওয়ার মর্তবায় পৌঁছে, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে; এটাই হুে ছ লতিফায়েআখফার মর্যাদা। এ অবস্থাতেই রু হ বা বিবেক ও আকলের পূর্ণশুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পরে আর বিবেককে কুপ্রবৃত্তির বশীভুত হতে হয় না। রাসূল সা. মানুষকে বিবেক সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন তার উদ্দেশ্য হুে ছ মানবাত্মার পরম উন্নতিলাভ। সোনার বাংলাদেশ
আরো শুনে রাখ মানবদেহে এমন একটি অংশ রয়েছে যে, সেই অংশটি যখন যথার্থভাবে ঠিক হয়ে যায়, তখন মানুষের পূর্ণ অস্তিত্ব ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানবদেহটিই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে সেই অংশটি যখন খারাপ হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত অস্তিত্বটিই খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ মানব দেহের কোনো অংশ বা কোনো অঙ্গই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। খুব ভালো করে জেনে নাও সে অংশটি হুে ছ মানুষের বিবেক।
বিশ্লেষণ : শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম চার প্রকার দলিল ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় । কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। এর যে কোনো একটি দ্বারা যে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ‘হালাল’ বৈধ ও গ্রহণীয় বলে প্রমাণিত হবে যে এটিই হালাল এবং যে কোনো বিষয় সুষ্পষ্টভাবে ‘হারাম’ নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বলে প্রমাণিত হবে তা হারাম।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল এবং হারাম অতি স্পষ্ট এবং এই সকল দলিল, প্রমাণ ও মাপকাঠি দ্বারা উভয়টিকে বেছে নেয়া অত্যন্ত সহজ। অধিকন্তু এটিও স্পষ্ট যে, হালালকে গ্রহণ করা যাবে এবং হারামকে বর্জন করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্রও নড়চড় করার অবকাশ নেই। কিন্তু হালাল ও হারাম পর্যায়দ্বয়ের মধ্যবর্তী আরো কিছু পর্যায় রয়েছে। যথা মাকরূহ, খেলাফেআওলা বা অবাঞ্ছনীয়, ইমাম ও খাঁটি ওলামাদের মতোবিরোধমূলক বিষয়াদি।
এতদ্ব্যতীত এমন আরো বহু বিষয়াদি আছে যা শরিয়তে লিপিবদ্ধ আছে এবং তা ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে প্রায়শই এমন বিষয়াদি আমাদের সম্মুখবর্তী হতে থাকে যা নির্দিষ্টভাবে হালাল বলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না, কিংবা হারাম বলেও স্থির করা যায় না এ সকল অনিশ্চিত ও সন্দেহভাজন বিষয়গুলোকে সযত্মে পরিহার করে চলাই একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা এ সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহ থেকে বিরত থাকলে এক দিকে জাগতিক ব্যাপারে যেমন লাভবান হওয়া যায়, কারণ সন্দেহের স্থানে পা রাখলেই স্বীয় মান-মর্যাদা কলুষিত হওয়ার এবং নানা প্রকার কুৎসা রটানোর সুযোগ উপস্থিত হয়।
অন্যদিকে তেমনি দীনের ব্যাপারেও লাভের সীমা থাকে না। কারণ যে ব্যক্তি স্বীয় নফ্স ও প্রবৃত্তিকে সন্দেহের স্থান থেকে বিরত রাখতে অভ্যস্ত হবে, সে নিশ্চয় যাবতীয় কুপ্রলোভনের বস্তু থেকে এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে স্বীয় নফ্সকে ফিরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
হারাম ও সন্দেহভাজন কাজ থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম নিজের বিবেককে যথার্থভাবে সুষ্ঠু ও ঠিক করতে হবে। কারণ মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য বৈদ্যুতিক মটর স্বরূপ। মটর ঠিকভাবে চালু থাকলে কারখানার প্রতিটি শাখা তার প্রতিটি অংশ ও সমস্ত কল-কবজার চাকাগুলো রীতিমত চলতে থাকবে। আর মটরে গোলযোগ থাকলে তার সংযোগ রক্ষাকারী সমস্ত মেশিন ও তার অংশগুলোর মধ্যেও গোলযোগ দেখা দিবে। অবশ্য মটরের সঙ্গের চাকাগুলো সক্রিয়সংযোগ রক্ষার প্রতিও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে মেশিনের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সংযোগবিহীন শুধু মটর চালালে উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং এ ধরনের নিরর্থক ও অনিয়মিত পরিচালনার ফলে কারখানা ফেল হয়ে যাবে। অতএব মেশিনের সমস্ত কল-কবজা ও তার বিভিন্ন অংশগুলোকেও রীতিমত চালু রেখে মোটরের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, তার ভাল-মন্দের প্রভাব সমস্ত কারখানার ওপর পড়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষের কর্তব্য তার বিবেক-বুদ্ধিকে সুষ্ঠু করে তার পর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেক দ্বারা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা।
দেহ আলোচনা
উপরোক্ত হাদিসের শেষ বাক্য ‘আলা ইন্নাফিল জাছাদে মুজগাতান’ মানবদেহের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ আছে যার উন্নতি-অবনতির উপর সম্পূর্ণ দেহের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে। এ তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টি তত্ত্ব ও দেহ-তত্ত্বের ইঙ্গিত দানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে, স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষè আত্মার উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মুখ্য উন্নতি নির্ভর করে। আত্মার উন্নতি সাধিত না হলে মানব জীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
মানুষের অজুদ বা অস্তিত্ব দুই ভাগে বিভক্ত স্থুলদেহ’ যা বাহ্য দষ্টিতে বা যান্ত্রিক সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে থাকে এবং ‘সূক্ষèআত্মা’ যা ঐরূপে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। মানুষের স্থুলদেহ সৃষ্টির মূলে যেমন বিভিন্ন উপাদান রয়েছে যথা পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নি তেমনি তার এ ভৌতিক দেহাভ্যন্তরে পাঁচ প্রকারের আত্মাও রয়েছে। যথা
১। পশুর আত্মা, যা দ্বারা খাওয়া শোয়া, কামরিপু চরিতার্থ করা ইত্যাদি প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়।
২। হিংস্র জীবের আত্মা : যা দ্বারা দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ ও রাগের বশীভূত হয়ে মারামারি কাটাকাটি করত: প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তি জন্মে থাকে।
৩। শয়তানের আত্মা : যার প্ররোচনায় পাপাচার, অহঙ্কার, মিথ্যা ও সূক্ষ্ম কূট-কৌশলের দ্বারা মানুষকে ধোকা দেয়া ইত্যাদির প্রবৃত্তি উদিত হয়।
৪। ফেরেশতা আত্মা : যা দ্বারা সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, সত্যতা, পরোপকারিতা ও আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করা ইত্যাদির আগ্রহ ও আকর্ষণ জন্মে থাকে।
৫। মানুষের আত্মা : যার কর্তব্য হুে ছ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আত্মাকে বশ করত: তাদেরকে কুপ্রবৃত্তির দিক থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে গুণান্বিত ও পরিচালিত করা এবং আল্লাহর মারেফত ও মহব্বত হাসিল করত: দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত তথা আল্লাহর হুকুম আহকাম জারির পরিবেশ কায়েম করার আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
প্রথম তিনটি আত্মাকেই তাসাওফের পরিভাষায় ‘নফসে আম্মারা’ বলা হয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম এ দুটিকে রূহ, আ’ক্বল বা লতিফা বলা হয় এবং এটিই হুে ছ বিবেক, বুদ্ধি ও মানবাত্মা।
দেখা গেল যে, এই পাঁচ প্রকারের আত্মাই তাসাওফের পরিভাষায় দুই নামে পরিচিত হয়েছে। একটি হল নফসে আম্মারা; এর তিনটি বিভাগ যথা পশুরআত্মা, হিংস্রজন্তুরআত্মা ও শয়তানেরআত্মা। দ্বিতীয়টি হলো রু হ অর্থাৎ মানবাত্মা বা বিবেক -আকল। এর দুটি বিভাগ যথা ফেরেশতার আত্মা ও মনুষত্বেরআত্মা।
রাসূল সা. ‘আলা ইন্না ফিল জাছাদে মোজগাতান’ বলে মানব দেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি নির্দেশ করেছেন, সে অংশটিই হুে ছ রু হ বা আকল-বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে; এটাই রাসূল সা. বলেছেন রু হ বা জ্ঞান-বিবেক রত্মটির উন্নতি হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং এর অবনতিতে সমগ্র মানবদেহের অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে, এই অংশটির উন্নতির অর্থ কী? বস্তুত প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতির বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দ্বারা। তাই এখন দেখতে হবে যে রু হ বা বিবেকের উপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। কারণ, রু হ মানবাত্মা বা বিবেক বলে যে দুটি আত্মার নামকরণ হয়েছিল অর্থাৎ ফেরেশতাআত্মা ও মনুষ্যত্বের আত্মা তাদের কর্তব্য ছিল সদাচার, সততা, সভ্যতা ও আল্লাহর বশবর্তীতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফস নামে যে অপর তিনটি শক্তি বা আত্মা আছে তাদেরকে বশে এনে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে পরিচালিত করা। অতএব রু হ বা বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তাই হবে। এ মহান কর্তব্য পালনে রু হ মানবাত্মা বা বিবেক যতোটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণমানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। এমনকি অবশেষে এই রু হ মানবাত্মা যে উর্দ্ধজগত থেকে এসেছিল পুনরায় সে মানবদেহকে নিয়ে সেই উর্দ্ধজগতে অর্থাৎ বেহেশতে গিয়ে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে রূহ মানবাত্মা নিজের ঐ কর্তব্যে ত্রু টি করত: নিজেই যদি নফস তথা ঐ তিন প্রকার আত্মার বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তা হলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির তিমির গর্তে পতিত হবে। অবশেষে ঐ রু হ মানবাত্মা মানবদেহকে নিয়ে সর্ব নিু জগতে তথা জাহান্নামে পৌঁছাবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদগণ রু হ বা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করেছেন। পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়ে ছিল যে, রু হ মানবাত্মা বা আকল ও বিবেককে তাসাওফের পরিভাষায় লতিফা নামেও নামকরণ হয়ে থাকে। সেই অনুসারেই রু হের উন্নতির পাঁচটি স্তরের নিুলিখিতরূপে নামকরণ করা হয়েছে।
১। লতিফায়েকলব : মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর নাম উু চরণ করত: জিকির করে তখন সে এ লতিফায়ে কালবের কর্তব্য পালন করে।
২। লতিফায়ে রু হ : মানুষ যখন আল্লাহর মহৎ গুণাবলীর ধ্যান করে এবং এই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যেও ঐ গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করে, যেমন : আল্লাহ দয়ালু, দয়াময় এর ধ্যান করত: এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, আমাকেও দয়ালু হতে হবে এবং দয়ালুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে তখন হয় লতিফায়ে রু হের কর্তব্য পালন।
৩। লতিফায়ে সের্র : মানুষ যখন আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিবিম্ব নিজের মধ্যে হাসিল করায় সচেষ্ট হয় তখন তার সিনার অভ্যন্তরে আল্লাহর মারেফাতের বা আল্লাহর গুণাবলীর তত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূতহয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয় অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে, এটাই হুে ছ লতিফায়ে সের্র এর কর্তব্য।
৪। লতিফায়ে খফী মানুষের মধ্যে যখন আল্লাহর মা'রেফতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভুত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণিত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয়। অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণভাবে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে। এটাই হ্ছে লতিফায়ে খফীর কর্তব্য।
৫। লতিফায়ে আখফা : মানুষ ফানা-ফিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহরগুণে গুণান্বিত হওয়ার মর্তবায় পৌঁছে, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে; এটাই হুে ছ লতিফায়েআখফার মর্যাদা। এ অবস্থাতেই রু হ বা বিবেক ও আকলের পূর্ণশুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পরে আর বিবেককে কুপ্রবৃত্তির বশীভুত হতে হয় না। রাসূল সা. মানুষকে বিবেক সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন তার উদ্দেশ্য হুে ছ মানবাত্মার পরম উন্নতিলাভ। সোনার বাংলাদেশ
This entry was posted on Monday, August 1, 2011 at 11:51 PM and is filed under আত্মা বিষয়ক,গবেষনা. You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed. You can leave a response.