Showing posts with label মাহে রমজান. Show all posts

মাহে রামাযান সম্পর্কে কিছু কথা

রামাযান মানে কি?‎

রমাযান আরবী শব্দ। আরবী মাস সমূহের মাঝে একটি মাসের নাম। যার আভিধানিক অর্থ ঝলসিয়ে দেয়া, ‎জ্বালিয়ে দেয়া। রামাযানকে রামাযান এজন্য বলা হয়-(ক) সর্ব প্রথম যখন রামাযানে রোযা ফরয হয় তখন ‎প্রচন্ড গরম ছিল তাই এ মাসকে রামাযান বলা হয়। (খ) রামাযান মাসে আল্লাহ তায়ালা তার অবারিত ‎রহমত ও বরকত দিয়ে বান্দার পূর্ব মাসের গোনাহকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন, এ হিসেবেও একে রামাযান ‎বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রোযা কাকে বলে?‎

আরবীতে যে শব্দকে সিয়াম বলে বলে তাকেই আমরা বাংলা উর্দু ও ফারসীতে রোযা বলে থাকি। রোযা ‎মৌলিকভাবে তিন যিনিস থেকে নিয়তের সাথে বিরত থাকার নাম। যথা-(ক) সহবাস (খ) খাবার গ্রহণ (ঘ) ‎পানীয় গ্রহণ।

রোযার ইতিহাস

দ্বিতীয় হিজরীতে মদীনায় থাকা অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করার মাধ্যমে রোযাকে ফরয ‎করেন মুসলমানদের উপর। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে সূরায়ে বাক্বারার ১৮৩ নং আয়াতে ‎ইরশাদ করেন-‎‏ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ‎ অর্থাৎ হে ‎মুমিনরা! আমি তোমাদের উপর রোযাকে ফরয করেছি যেমন ফরয করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের উপর যেন ‎তোমরা পরহেযগার হতে পার।(সূরা বাক্বারা-১৮৩) এই আয়াতের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট বুঝা যায়, ‎উম্মাতে মুহাম্মদীর পূর্বে অন্য নবীর উম্মাতের উপরও রোযা ফরয ছিল। যেমন বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে যে ‎বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তার সারাংশ হচ্ছে-কারো কারো মতে পূর্বের সকল উম্মতের উপরই তা ‎ফরয ছিল কারো কারো মতে কিছু কিছু উম্মতের উপর। তবে এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, ‎খৃষ্টানদের উপর রামাযানের রোযা ফরয ছিল উম্মাতে মুহাম্মদীর মত। খৃষ্টানদের ক্ষেত্রে বিধান ছিল ‎রামাযানের রাতে ঘুমানোর পর থেকে পরদিনের সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করতে ‎পারবেনা। এ বিষয়টি তাদের কাছে কঠিন মনে হলে শীত ও গ্রীষ্মকালে তারা মনমত রোযার সংখ্যা পাল্টে ‎নিত। অর্থাৎ যে সময়ের রমাযান মাস কষ্টদায়ক হত সে সময় তারা রোযা ১০ টা রাখতো পরের বছর ২০ ‎টি অতিরিক্ত রেখে রোযা ৫০টি রাখত। রোযার ফরয হবার পরও খৃষ্টানদের উপর আপতিত বিধান অনুযায়ী ‎মুসলমানরা রোযা রাখতে শুরু করেন। অর্থাৎ রামাযানের রাতে ঘুমানোর পর থেকেই রোযা শুরু হয়ে ‎যায়। ঘুম থেকে জেগে কোন কিছু পানাহার করা ও স্ত্রী সহবাস করতে পারবেনা। পরবর্তীতে আবু কায়েস ‎বিন সারমা রাঃ সহ কিছু সাহাবী আবেদন করলে আল্লাহ তায়ালা সহজতার আয়াত নাজিল করে জানিয়ে ‎দিলেন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত রোযা নেই। পর থেকে রোযা শুরু। (তাফসীরে তাবারী-৩/৪০৯) ‎

খোদাভীরু হবার মাস মাহে রামাযান

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন আমি তোমাদের উপর রোযা ফরয করেছি যেন তোমরা মুত্তাকী তথা খোদাভীরু ‎হতে পার। রোযার মাধ্যমে একজন বান্দা খোদাভীরু এভাবে হয় যে, একাকি চুপটি ঘরে রোযাদার যখন ‎থাকে তখন সে ইচ্ছে করলেই পানাহার করতে পারে কিন্তু সে এ থেকে কেবল বিরত থাকে আল্লাহর ‎আদেশ অমান্য হয়ে যাবার ভয়ে, একাজটি সে করে থাকে শুধু আল্লাহর ভয়ে, কারণ সেখানেতো কোন ‎মানুষ তাকে দেখছেনা। সুতরাং রোযা রাখাটাই খোদাভীরুতার একটি পরিচায়ক। সুতরাং রামাযানে এই ‎প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য সময়ে যেন বান্দা কোন গোনাহ করতে আল্লাহ দেখছেন এই ভয়ে বিরত থাকে এর ‎একটি প্রশিক্ষণও এই রামাযান। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন তোমরা মুত্তকী হবার জন্য আমি রোযাকে ফরয ‎করেছি।

রামাযানের ফযীলত

عن أبي هريرة : قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن ‏وغلقت أبواب النار فلم يفتح منها باب وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب وينادي مناد يا باغي الخير أقبل ويا باغي ‏الشر أقصر ولله عتقاء من النار وذلك كل ليلة قال وفي الباب عن عبد الرحمن بن عوف و ابن مسعود و سلمان ‏
قال الشيخ الألباني : صحيح ‏

অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেছেন-যখন রামাযানের প্রথম রাত আসে ‎তখন শয়তান ও জীনদের পায়ে বেড়ি পড়ানো হয়। এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, তাই ‎জাহান্নামের কোন দরজা খোলা থাকেনা, ও জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, এমনকি জান্নাতের কোন ‎দরজা বন্ধ থাকেনা। আর একজন আহবানকারী ডাকতে থাকে-হে কল্যাণ প্রার্থী! এগিয়ে এসো! আর ‎মন্দতাপ্রার্থী! তুমি ফিরে যাও! আর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক গোনাহগারকে জাহান্নাম থেকে ‎মুক্তি দেয়া হয়।(অর্থাৎ তার ক্ষমার সীদ্ধান্ত গৃহিত হয়।) (তিরমিজি শরীফ-রামাযান অধ্যায়)‎
عن أبي هريرة : قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من صام رمضان وقامه إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن ‏قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ‏
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে ও ‎পূণ্যের আশায় রামাযানের রোযা রাখে আর ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় শুয়ার পূর্বে নফল(তারাবীহ) ‎পড়ে তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় শবে কদরে নফল ‎পড়ে তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (তিরমিজী শরীফ-রামাযান অধ্যায়)‎

সেহরীর ফযীলত

أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه و سلم ( تسحروا فإن في السحور بركة ) ‏
অনুবাদ-হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-তোমরা সেহরী খাও কেননা সেহরীতে ‎বরকত নিহিত। (বুখারী শরীফ-২/৬৭৮)‎
عن عمرو بن العاص أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحر
অনুবাদ-হযরত আমর বিন আস থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-আমাদের ও আহলে কিতাবীদের ‎মাঝে রোযার মাঝে পার্থক্য নির্ণায়ক হল সেহরী খাওয়া। (মুসলিম শরীফ-৩/১৩০)‎

বান্দাদের পূণ্য আর গোনাহমুক্তির ক্ষেত্রে বোনাসময় মাস

গোনাহগার বান্দাদের গোনাহ মাফের ব্যাপকতার জন্য এ মাস এক বিশাল সুযোগের মাস। রামাযানের ‎শুরু থেকেই গোনাহ মাফের যে অফার শুরু হয় তা থাকে ঈদের চাঁদ উঠা পর্যন্ত। একবার কোন ইবাদাত ‎করলে অন্য মাসে ৭০ বার সে ইবাদাত করার সোয়াব পাবার নিশ্চয়তা। সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর ‎অবারিত মাগফিরাত আর বরকতপূর্ণ এ মাস। এ মাসে যেন আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা আর বরকতের ঝাঁপি ‎খুলে দিয়েছেন। ‎

من تقرب فيه بخصلة من الخير كان كمن أدى فريضة فيما سواه و من أدى فيه فريضة كان كمن أدى سبعين فريضة فيما سواه ‏‎ ‎
অনুবাদ-সালমান রাঃ থেকে বর্ণিত একদা নবীজী সাঃ খুতবায় বলেন-যে ব্যক্তি এ মাসে (নফল) নেক ‎আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে, সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় হবে যে রামাযান ছাড়া অন্য সময় ‎একটি ফরয আদায় করল, আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করবে সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ‎ফরয আদায় করল। (সহীহ ইবনে খুজাইমা-৩/১৯১)‎

আহবান

প্রিয় পাঠক/পাঠিকারা! আসুন রহমত বরকত মাগফিরাতে পূর্ণ এই পবিত্র মাসটি আমরা এবার অন্য সময়ের ‎তুলনায় পবিত্র ও সুন্দর করে পালন করি। তারাবিহ-তাহাজ্জুদ, সেহরী-ইফতার, জিকির-তাসবীহ, প্রথম ‎ওয়াক্তে-জামাতে নামায পড়া ইত্যাদীর মাধ্যমে এ রামাযানটি পালন করি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্বের সাথে। সাথে ‎সাথে সকল প্রকার গোনাহ ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত থাকি দৃঢ়তার সাথে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ ‎পবিত্র মাসে ইবাদত করে তার প্রিয় বান্দা হবার তৌফিক দান করুন। সাথে সাথে যারা এ মাসে নিজের ‎গোনাহকে মাফ করাতে না পারে তাদের ক্ষেত্রে হযরত জিবরাঈল আঃ যে অভিশাপ করেছেন যে ব্যক্তি এ ‎মাসে গোনাহ মাফ করাতে না পারে সে ব্যক্তি সবচে দূর্ভাগা নবীজী সাঃ যে বদদুআর প্রদুত্তরে ‎বলেছেন আমীন, সেই মকবুল বদ দুআকৃত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত না হতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিফাযত ‎করুন। আমীন।

লুৎফর ফরাজী সত্র: ইন্টারনেট
সবটুকু একত্রে পড়ুন "মাহে রামাযান সম্পর্কে কিছু কথা"

মাহে রমাযান ও রোযার ফযীলত

রোযা ফারসী শব্দ, আরবী সিয়াম বা সাওম। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। শরীয়তের দৃষ্টিতে সিয়াম অর্থ সোবেহ সাদেক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্ভোগ ও শরীয়াত নির্ধারিত বিধি-নিষেধ হতে নিয়তসহ বিরত থাকাকে রোযা বলে। শরীয়াতে ঈমান, সালাত ও যাকাতের পরেই রোযার স্থান। ইহা ইসলামের চতুর্থ রোকন। আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে ইহা একটি অপরিহার্য ইবাদত। বস্তুত রোযা মানুষকে কু-প্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে, রাসূল (সা.) বলেন; রোযা ঢাল স্বরূপ। রোযা কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যেই রাখা হয়। এ কারণে রোযাদারদেরকে আল্লাহ অত্যাধিক ভালবাসেন। হাদীসে কুদসীতে এসেছে আল্লাহ বলেন; রোযা একমাত্র আমারই জন্য আমি নিজেই এ পুরস্কার দেব। কুরআনে শুধু রোযা রাখার হুকুমই হয়নি, বরং রোযার নিয়ম পদ্ধতিও বলে দেয়া হয়েছে, রমযানের মহাত্ম ও বরকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে মাসের রোযা শরীয়ত ফরজ করেছে তার ফযীলত ও বরকত অনেক। এ কারণেই রাসূলে কারীম (সাঃ) এ মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এ মাসকে সকল মাস অপেক্ষা উৎকৃষ্টতম বলেছেন।

আমরা জানি পৃথিবীর সব দেশের মানুষই বার মাসে বছর হিসাব করে, কিন্তু এই বার মাসের মধ্যে একটি মাসের গুরুত্ব এতো বেশি কেন? কোন কারণে এই মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়। মূলত এই মাসের সম্মান মর্যাদা গুরুত্ব ফযীলত বরকত নাজাত মাগফিরাত একমাত্র কুরআন এর সম্মানের কারণে হয়েছে। কুরআন যদি এই মাসে নাযিল না হতো তাহলে এই রমযান মাসের এত ফযীলত হতো না। যার কারণে প্রত্যেক এবাদতের গুণ এত বৃদ্ধি পেল, তাকে আজ আমরা বুঝার চেষ্টা করি না। তার সাথে আমরা ভাল ব্যবহার করি না । তাকে দিয়ে নিজ , পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, এক কথায় কিছুই পরিচালনা করি না। অথচ আমরা রমযান মাসের প্রতিটি দিনই রোযা রাখি। আসলে কুরআনকে সঠিক নিয়মে বুঝার জন্যই এ মাসকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন; রমযান মাস যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্য পথপ্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জ্বল নিদর্শন ও প্রভেদকারী কুরআন অবর্তীণ হয়েছে। (সূরা বাকারা ১৮৫)
রমযানের রোযা পালন ফরজ, মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, ফলে আশা করা যায় যে তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে।” অর্থাৎ তোমরা মুত্তাকী হতে পারবে। (সূরা বাকারা : ১৮৩)
উপর্যুক্ত আয়াত শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্য নয় বরং এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্য যে, মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোযার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার একটি স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। রোযার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন- “যে ব্যক্তি কোন শরয়ী ওযর বা রোগ ছাড়া রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দিবে সে যদি সারা জীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরণ হবে না”।

প্রকৃত পক্ষে রমযান এসেছে বান্দাকে তাকওয়া শিক্ষা দেওয়ার জন্য। সারা বছর মানুষ শয়তানের কুআচরনের কারণে কিছু না কিছু গুনাহ করে থাকে। রোযার এক মাসে সাধনা করলে ঐ সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এই তাকওয়া আসলে এমন এক সম্পদ যা আল্লাহর মহব্বত ও ভয় থেকে পয়দা হয় । আল্লাহ উপর ঈমান, তার গুণাবলীর দয়া অনুগ্রহের গভীরে অনুভূতি থেকে মহব্বতের প্রেরণা সৃষ্টি হয় এবং তার অন্যগুণ রাগ, ক্ষোভ ও শাস্তি দানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে ভয়ের অনুভূতি জাগ্রত হয়। মহব্বত ও ভয়ের এ মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া যা সকল নেক কাজের উৎস এবং সকল পাপ কাজ থেকে বাঁচার সত্যিকার উপায়।

প্রকৃত রোযাঃ- রোযার এ মহান উদ্দেশ্য তখনই হাসিল করা যেতে পারে যখন রোযা পূর্ণ অনুভূতির সাথে রাখা হবে এবং ঐ নিষিদ্ধ কাজ থেকে রোযাকে রক্ষা করা হবে। যার প্রভাবে রোযা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। প্রকৃত রোযা হলো যার সাহায্যে মানুষ তার মন মস্তিষ্ক ও সকল যোগ্যতাকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং প্রবৃত্তির চাহিদা পদদলিত করে।
* রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- যে ব্যক্তি রোযা রেখে মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত হলো না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী)
*এমন বহু রোযাদার আছে যে, রোযাদার ক্ষুধা তৃষ্ণার্ত ভোগ করা ছাড়া তাদের নেকীর পাল্লায় আর কিছু পড়ে না। (মিশকাত)
এবার আসুন রোযাপালনকারীর জন্য কি সু-সংবাদ রাসূলে কারীম (সাঃ) দিয়েছেন এবং তাদের মর্যাদা কত উর্ধ্বে জেনে নেই ;

১. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে একটি জিনিস দান করবে তাকে জান্নাতের দরজা থেকে এই বলে ডাকা হবেঃ হে আল্লাহর বান্দা! এই যে এই দরজাটি তোমার জন্য ভালো। কাজেই নামাযীদেরকে নামাযের দরজা হতে ডাকা হবে। মুজাহিদদেরকে ডাকা হবে জিহাদের দরজা হতে। রোযাদাদেরকে ডাকা হবে “রাইয়্যান” দরজা হতে । দাতাদেরকে ডাকা হবে সদাকার দরজা হতে । আবু বকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার বাপ মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, কোন ব্যক্তিকে কি এ সবগুলি দরজা থেকে ডাকা হবে ..? যদিও এর কোন প্রযোজন নেই। জবাব দিলেন হ্যাঁ । আর আমি আশা করি তুমি সবগুলোতে অর্ন্তভূক্ত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

২. সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী (সাঃ) বলেনঃ- জান্নাতের একটি দরজা আছে । তাকে বলা হয় রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন এই দরজা দিয়ে কেবল মাত্র রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে রোযাদারগণ কোথায় ? তখন রোযাদারগণ দাড়িয়ে যাবে, তাদেরকে প্রবেশের আদেশ দেওয়া হবে। রোযাদারগণ প্রবেশ করার পর দরজা টি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এবং তারপর এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী ও মুসলিম)

৩. আবু হুরায়রা (রা থেকে বর্নিত। নবী করীম (সা বলেছেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান সহকারে ও সাওয়াব লাভের প্রত্যাশায় রমযানের রোযা রাখে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মা’ফ করে দেওয়া হয়। (বুখারী ও মুসলিম)

৪.আবু হুরায়রা (রা থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা বলেছেন, যখন রমযান মাস আসে, জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয় । আর জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং শয়তানকে শৃংখলিত করে রাখা হয়। (বুখারী ও মুসলিম)

শেষ কথা:- সত্যিকার মুমিন বান্দা সর্বদাই আল্লাহর এবাদত করবে। কোন নির্দিষ্ট মাস, জায়গা অথবা জাতির সাথে মিলে আমল করবে না, বরং সর্বদা সে এবাদত করবে। মুমিন বান্দা মনে করবে যিনি রমযানের প্রভূ তিনি অন্যান্য সকল মাসেরও প্রভূ । তিনি সকল কাল ও স্থানের প্রভূ । রমযান শেষ হয়ে গেলেও শাওয়ালের ছয় রোযা, আশুরা, আরাফা, সোমবার, বৃহস্পতিবার ইত্যাদি নফল রোযা রয়েছে। তারাবীহের নামায শেষ হয়ে গেলেও তাহাজ্জুদ নামায বাকি আছে সারা বছর। অতএব নেক আমল সব সময় করা যায়। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন
সবটুকু একত্রে পড়ুন "মাহে রমাযান ও রোযার ফযীলত"

খোশ আমদেদ মাহে রামাযান

রামাযান মানে কি?‎

রমাযান আরবী শব্দ। আরবী মাস সমূহের মাঝে একটি মাসের নাম। যার আভিধানিক অর্থ ঝলসিয়ে দেয়া, ‎জ্বালিয়ে দেয়া। রামাযানকে রামাযান এজন্য বলা হয়-(ক) সর্ব প্রথম যখন রামাযানে রোযা ফরয হয় তখন ‎প্রচন্ড গরম ছিল তাই এ মাসকে রামাযান বলা হয়। (খ) রামাযান মাসে আল্লাহ তায়ালা তার অবারিত ‎রহমত ও বরকত দিয়ে বান্দার পূর্ব মাসের গোনাহকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন, এ হিসেবেও একে রামাযান ‎বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রোযা কাকে বলে?‎

আরবীতে যে শব্দকে সিয়াম বলে বলে তাকেই আমরা বাংলা উর্দু ও ফারসীতে রোযা বলে থাকি। রোযা ‎মৌলিকভাবে তিন যিনিস থেকে নিয়তের সাথে বিরত থাকার নাম। যথা-(ক) সহবাস (খ) খাবার গ্রহণ (ঘ) ‎পানীয় গ্রহণ।

রোযার ইতিহাস

দ্বিতীয় হিজরীতে মদীনায় থাকা অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করার মাধ্যমে রোযাকে ফরয ‎করেন মুসলমানদের উপর। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে সূরায়ে বাক্বারার ১৮৩ নং আয়াতে ‎ইরশাদ করেন-‎‏ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ‎ অর্থাৎ হে ‎মুমিনরা! আমি তোমাদের উপর রোযাকে ফরয করেছি যেমন ফরয করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের উপর যেন ‎তোমরা পরহেযগার হতে পার।(সূরা বাক্বারা-১৮৩) এই আয়াতের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট বুঝা যায়, ‎উম্মাতে মুহাম্মদীর পূর্বে অন্য নবীর উম্মাতের উপরও রোযা ফরয ছিল। যেমন বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে যে ‎বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তার সারাংশ হচ্ছে-কারো কারো মতে পূর্বের সকল উম্মতের উপরই তা ‎ফরয ছিল কারো কারো মতে কিছু কিছু উম্মতের উপর। তবে এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, ‎খৃষ্টানদের উপর রামাযানের রোযা ফরয ছিল উম্মাতে মুহাম্মদীর মত। খৃষ্টানদের ক্ষেত্রে বিধান ছিল ‎রামাযানের রাতে ঘুমানোর পর থেকে পরদিনের সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করতে ‎পারবেনা। এ বিষয়টি তাদের কাছে কঠিন মনে হলে শীত ও গ্রীষ্মকালে তারা মনমত রোযার সংখ্যা পাল্টে ‎নিত। অর্থাৎ যে সময়ের রমাযান মাস কষ্টদায়ক হত সে সময় তারা রোযা ১০ টা রাখতো পরের বছর ২০ ‎টি অতিরিক্ত রেখে রোযা ৫০টি রাখত। রোযার ফরয হবার পরও খৃষ্টানদের উপর আপতিত বিধান অনুযায়ী ‎মুসলমানরা রোযা রাখতে শুরু করেন। অর্থাৎ রামাযানের রাতে ঘুমানোর পর থেকেই রোযা শুরু হয়ে ‎যায়। ঘুম থেকে জেগে কোন কিছু পানাহার করা ও স্ত্রী সহবাস করতে পারবেনা। পরবর্তীতে আবু কায়েস ‎বিন সারমা রাঃ সহ কিছু সাহাবী আবেদন করলে আল্লাহ তায়ালা সহজতার আয়াত নাজিল করে জানিয়ে ‎দিলেন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত রোযা নেই। পর থেকে রোযা শুরু। (তাফসীরে তাবারী-৩/৪০৯) ‎

খোদাভীরু হবার মাস মাহে রামাযান

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন আমি তোমাদের উপর রোযা ফরয করেছি যেন তোমরা মুত্তাকী তথা খোদাভীরু ‎হতে পার। রোযার মাধ্যমে একজন বান্দা খোদাভীরু এভাবে হয় যে, একাকি চুপটি ঘরে রোযাদার যখন ‎থাকে তখন সে ইচ্ছে করলেই পানাহার করতে পারে কিন্তু সে এ থেকে কেবল বিরত থাকে আল্লাহর ‎আদেশ অমান্য হয়ে যাবার ভয়ে, একাজটি সে করে থাকে শুধু আল্লাহর ভয়ে, কারণ সেখানেতো কোন ‎মানুষ তাকে দেখছেনা। সুতরাং রোযা রাখাটাই খোদাভীরুতার একটি পরিচায়ক। সুতরাং রামাযানে এই ‎প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য সময়ে যেন বান্দা কোন গোনাহ করতে আল্লাহ দেখছেন এই ভয়ে বিরত থাকে এর ‎একটি প্রশিক্ষণও এই রামাযান। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন তোমরা মুত্তকী হবার জন্য আমি রোযাকে ফরয ‎করেছি।

রামাযানের ফযীলত

عن أبي هريرة : قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن ‏وغلقت أبواب النار فلم يفتح منها باب وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب وينادي مناد يا باغي الخير أقبل ويا باغي ‏الشر أقصر ولله عتقاء من النار وذلك كل ليلة قال وفي الباب عن عبد الرحمن بن عوف و ابن مسعود و سلمان ‏
قال الشيخ الألباني : صحيح ‏
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেছেন-যখন রামাযানের প্রথম রাত আসে ‎তখন শয়তান ও জীনদের পায়ে বেড়ি পড়ানো হয়। এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, তাই ‎জাহান্নামের কোন দরজা খোলা থাকেনা, ও জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, এমনকি জান্নাতের কোন ‎দরজা বন্ধ থাকেনা। আর একজন আহবানকারী ডাকতে থাকে-হে কল্যাণ প্রার্থী! এগিয়ে এসো! আর ‎মন্দতাপ্রার্থী! তুমি ফিরে যাও! আর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক গোনাহগারকে জাহান্নাম থেকে ‎মুক্তি দেয়া হয়।(অর্থাৎ তার ক্ষমার সীদ্ধান্ত গৃহিত হয়।) (তিরমিজি শরীফ-রামাযান অধ্যায়)‎
عن أبي هريرة : قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من صام رمضان وقامه إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن ‏قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ‏
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে ও ‎পূণ্যের আশায় রামাযানের রোযা রাখে আর ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় শুয়ার পূর্বে নফল(তারাবীহ) ‎পড়ে তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় শবে কদরে নফল ‎পড়ে তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (তিরমিজী শরীফ-রামাযান অধ্যায়)‎

সেহরীর ফযীলত

أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه و سلم ( تسحروا فإن في السحور بركة ) ‏
অনুবাদ-হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-তোমরা সেহরী খাও কেননা সেহরীতে ‎বরকত নিহিত। (বুখারী শরীফ-২/৬৭৮)‎
عن عمرو بن العاص أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحر
অনুবাদ-হযরত আমর বিন আস থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-আমাদের ও আহলে কিতাবীদের ‎মাঝে রোযার মাঝে পার্থক্য নির্ণায়ক হল সেহরী খাওয়া। (মুসলিম শরীফ-৩/১৩০)‎

বান্দাদের পূণ্য আর গোনাহমুক্তির ক্ষেত্রে বোনাসময় মাস

গোনাহগার বান্দাদের গোনাহ মাফের ব্যাপকতার জন্য এ মাস এক বিশাল সুযোগের মাস। রামাযানের ‎শুরু থেকেই গোনাহ মাফের যে অফার শুরু হয় তা থাকে ঈদের চাঁদ উঠা পর্যন্ত। একবার কোন ইবাদাত ‎করলে অন্য মাসে ৭০ বার সে ইবাদাত করার সোয়াব পাবার নিশ্চয়তা। সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর ‎অবারিত মাগফিরাত আর বরকতপূর্ণ এ মাস। এ মাসে যেন আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা আর বরকতের ঝাঁপি ‎খুলে দিয়েছেন। ‎
من تقرب فيه بخصلة من الخير كان كمن أدى فريضة فيما سواه و من أدى فيه فريضة كان كمن أدى سبعين فريضة فيما سواه ‏‎ ‎
অনুবাদ-সালমান রাঃ থেকে বর্ণিত একদা নবীজী সাঃ খুতবায় বলেন-যে ব্যক্তি এ মাসে (নফল) নেক ‎আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে, সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় হবে যে রামাযান ছাড়া অন্য সময় ‎একটি ফরয আদায় করল, আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করবে সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ‎ফরয আদায় করল। (সহীহ ইবনে খুজাইমা-৩/১৯১)‎


সবটুকু একত্রে পড়ুন "খোশ আমদেদ মাহে রামাযান"

পবিত্র রমজান মাস সম্পর্কে কিছু কথা

আমরা যখন এ মাসের গুরুত্ব অনুভব করলাম তখন আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল কীভাবে এ মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো যায় সে প্রচেষ্টা চালানো। এ মাসে হেদায়াতের আলোকবর্তিকা আল-কোরআন নাজিল হয়েছে। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। একজন ঘোষণাকারী ভাল কাজের আহ্বান জানাতে থাকে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলে। সাথে সাথে এটা হল মাগফিরাতের মাস, জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদর যা হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। আমাদের অনেকের ধারণা রমজান মাস সিয়াম পালন ও তারাবীহ আদায়ের মাস। ব্যাস ! আর কীসের আমল ? দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকছি এটা কম কি? না, ব্যাপারটা শুধু এ টুকুতে সীমিত নয়। রমজান একটি বিশাল বিদ্যাপীঠ।

এ রমজানে আমরা কি কি নেক আমল করতে পারি তা নিম্নে আলোচনা করা হল :—
(১) কিয়ামুল লাইল
কিয়ামুল লাইল শব্দের অর্থ রাতের সালাত। অর্থাৎ সালাতে তারাবীহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :—
من قام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه. رواه مسلم
যে রমজান মাসে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রাতে সালাত আদায় করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। বর্ণনায় : মুসলিম

সালাতে তারাবীহ যেমন কিয়ামুল লাইলের মধ্যে পড়ে তেমনি শেষ রাতে তাহাজ্জুদও সালাতুল লাইল এর অন্তর্ভুক্ত। ইমাম সাহেবের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জামাতে সালাত আদায় করলে রমজানের পূর্ণ রাত সালাত আদায়ের সওয়াব অর্জিত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة (رواه أبو داود)
ইমাম সাহেব সালাত শেষ করা পর্যন্ত তার সাথে যে সালাত আদায় করবে সে পূর্ণ এক রাত সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে। বর্ণনায় : আবু দাউদ

যে সামর্থ্য রাখে সে ইমামের সাথে সালাত শেষ করে একা একা যত ইচ্ছা তত সালাত আদায় করবে। এ ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে যে অমনোযোগিতা দেখা যায় তা হল রমজানের প্রথম রাতে তারা সালাতে অংশ নিতে পারে না। আবার অনেককে রমজানের শেষ দিকে অলসতায় পেয়ে বসে। ফলে তারা পূর্ণ রমজানের কিয়ামুল লাইলের সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন।
(২) আল-কোরআন খতম ও তিলাওয়াত :
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة . . .
সিয়াম ও কোরআন কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে...।

হাদিসে এসেছে, রমজানে জিবরাইল রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কোরআন পাঠ করে শোনাতেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ণ কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে জিবরাইলের কাছে তুলে ধরতেন। আল-কোরআন তিলাওয়াত হল সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির। সিয়াম পালনকারী এ জিকির থেকে বঞ্চিত থাকতে পারেন না। আল-কোরআন তিলাওয়াতের একটি সঠিক দিক-নির্দেশনামুলক প্রবন্ধ এ বইয়ের শেষ দিকে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পাঠক এ থেকে উপকৃত হতে পারবেন। যদি কেউ কোরআন তিলাওয়াত করতে অপারগ হন তাহলে বিভিন্ন তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ আদায়ের মাধ্যমে মুখে আল্লাহর জিকির অব্যাহত রাখবেন।

(৩) সদকা বা দান :
প্রখ্যাত সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس بالخير، وكان أجود ما يكون في شهر رمضان. رواه مسلم
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমজানে তার বদান্যতা আরো বেড়ে যেত। বর্ণনায় : মুসলিম

ইমাম শাফেয়ি (র.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করে তার উম্মতের জন্য উত্তম কাজ হল রমজান মাসে তারা বেশি করে দান-সদকা করবে। কারণ এ মাসে মানুষের প্রয়োজন বেশি থাকে। অপরদিকে রমজান হল জিহাদের মাস। তাই প্রত্যেকের উচিত অর্থ-সম্পদ দান করার মাধ্যমে জিহাদে অংশ নেয়া।

(৪) এতেকাফ :—
ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يعتكف العشر الأواخر من رمضان . رواه مسلم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন। বর্ণনায় ; মুসলিম। এতেকাফ প্রসঙ্গে ইমাম যুহরি বলেন, আশ্চর্যজনক হল মুসলমানরা এতেকাফ পরিত্যাগ করে অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আসার পর থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত কখনো এতেকাফ পরিত্যাগ করেননি।

(৫) ওমরাহ আদায় :—
যেমনটি হাদিসে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
عمرة في رمضان كحجة معي
রমজান মাসে ওমরাহ আদায় আমার সাথে হজ আদায়ের সমতুল্য।

(৬) রোজাদারদের ইফতার করানো :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من فطر صائما كان له مثل أجره ، غير أنه لا ينقص من أجر الصائم شيئا. رواه أحمد
যে ব্যক্তি কোন সিয়াম পালনকারীকে (রোজাদারকে) ইফতার করাবে সে সিয়াম পালনকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে, তবে তাতে সিয়াম পালনকারীর সওয়াব বিন্দুমাত্র কমে যাবে না। বর্ণনায় : আহমদ
(৭) দোয়া-প্রার্থনা করা :
আল্লাহ রাব্বুল সিয়ামের বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন -
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ (البقرة : 186)
আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। প্রার্থনাকারী যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে আমি তার প্রার্থনায় সাড়া দেই। সূরা আল-বাকারা : ১৮৬। তাই সিয়াম পালনকারী আল্লাহর কাছে অধিক পরিমাণে দোয়া-প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—

ثلاث دعوات مستجابة : دعوة الصائم، دعوة المظلوم، دعوة المسافر. رواه البيهقي في شعب الإيمان وصححه الألباني في الجامع
তিনজনের দোয়া কবুল করা হয় ; সিয়াম পালনকারীর দোয়া, অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া এবং মুসাফিরের দোয়া। সহি আল-জামে

(৮) তওবা করা :
সর্বদা তওবা করা ওয়াজিব। বিশেষ করে এ মাসে তো বটেই। এ মাসে তওবার অনুকূল অবস্থা বিরাজ করে। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নাম থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া রমজান মাসের সকল ইবাদত বন্দেগি তওবার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
رغم أنف رجل دخل عليه رمضان، ثم انسلخ قبل أن يغفر له (رواه الترمذي)
যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও তার পাপ ক্ষমা করাতে পারেনি তার নাক ধুলায় ধূসরিত হোক। বর্ণনায় : তিরমিজি

তাই রমজান মাসটাকে তওবা ও ক্ষমা পাওয়ার মাস হিসেবে গ্রহণ করে সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।

(৯) নেক আমল করতে অধিক হারে চেষ্টা অব্যাহত রাখা:
বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে -
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل العشر أحيى الليل، وأيقظ أهله، وجد وشد المئزر. رواه مسلم
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : যখন রমজানের শেষ দশক এসে যেত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন রাত্রি জাগরণ করতেন, পরিবারবর্গকে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে দিতেন, লুঙ্গি শক্ত ও ভাল করে বেঁধে (প্রস্তুতি গ্রহণ) নিতেন। বর্ণনায় : মুসলিম

তিনি আরো বলেন :—
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجتهد في العشر الأواخر ما لا يجتهده في غيره. رواه مسلم
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত-বন্দেগিতে যে পরিশ্রম করতেন অন্য সময় এ রকম করতেন না। বর্ণনায় : মুসলিম

(১০) ইসলামি শিক্ষা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব প্রদান :
ইসলামি শিক্ষা হল সকল প্রকার শিক্ষার মূল। তা ছাড়া দুটি বিষয় লক্ষ্য করা খুব জরুরি
এক. ইসলামের সকল ইবাদত-বন্দেগি সঠিকভাবে আদায় করতে হলে ইসলামি শিক্ষা অর্জন করতে হয়। এ ব্যাপারে কোন ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। সালাতের নিয়মকানুন, সিয়ামের বিধান, জাকাতের নিয়ম-নীতি, হজের আহকাম না শিখে এগুলো আদায় করা যায় না।

দুই. আল-কুরআনের তফসির শেখা ও অধ্যয়ন অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে আমরা যে সকল সূরা-কেরাত সালাতের মাঝে পড়ে থাকি সেগুলোর মর্ম অনুধাবন করে তিলাওয়াত করা দরকার। কাজেই রমজান মাসকে আমরা ইসলামি শিক্ষা অর্জন ও শিক্ষা প্রসারের একটি সুযোগ হিসেবে নিতে পারি। মূর্খতার অবসান ঘটানো সিয়ামের একটা গুরুত্বপূর্ণ দাবি।

যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :—
من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل، فليس لله حاجة أن يدع طعامه وشرابه . رواه البخاري

যে মিথ্যা কথা ও কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করতে পারল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। বর্ণনায় : বোখারি

হাদিসটি দ্বারা স্পষ্ট বুঝে আসে যদি মূর্খতা পরিহার না করা হয় তবে সিয়াম আল্লাহর কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর মূর্খতা ত্যাগ করা যাবে শুধু শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।
সবটুকু একত্রে পড়ুন "পবিত্র রমজান মাস সম্পর্কে কিছু কথা"