Showing posts with label গবেষনা. Show all posts
![]() |
বিশ্বখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ : যদি আগামী একশ বছরের মধ্যে শুধু ইংল্যান্ড নয়, সারা ইউরোপকে শাসন করার সম্ভাবনা কোনো ধর্মের থেকে থাকে, তাহলে সে ধর্ম হবে শুধু ইসলাম। আমি সবসময় মুহাম্মাদ (সা.)-এর ধর্ম সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছি এর আশ্চর্য জীবনীশক্তির জন্য।
আমার মনে হয়, ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা জীবনের পরিবর্তিত ধাপের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই কারণেই প্রতিটি যুগেই এর আবেদন রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যদি মুহাম্মাদ (সা.)-এর মতো একজন মানুষ আধুনিক বিশ্বের একনায়কের পদ অধিকার করতেন, তাহলে তিনি এমন সাফ্যলের সঙ্গে এর সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারতেন যা এর জন্য প্রয়োজনীয় সুখ ও শান্তি বয়ে আনত । (Genuine Islam, vol.-1)
ঐতিহাসিক ফিলিপ কে. হিট্টি : পৃথিবীর সব ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলামই পেরেছিল জাত ও বর্ণের ভেদাভেদ মুছে ফেলতে। (History of the Arabs, page 3)
মানবতাবাদী এম. এন. রায় : ইসলামের অসাধারণ সাফল্যের মূলে আছে এর বৈপ্লবিক তাৎপর্য । ইসলামই প্রথম সামাজিক সাম্য প্রবর্তন করেছিল যা সমস্ত দেশের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে তখনও অজানা ছিল । (The Historical Role of Islam)
অহিংসবাদী মহাত্মা গান্ধী : মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন একজন মহান পয়গম্বর । তিনি সাহসী ছিলেন এবং আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না । তিনি কখনও এক কথা বলে অন্য কাজ করতেন না। এই পয়গম্বর ছিলেন ফকিরের মতো । তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে প্রচুর সম্পদ করতে পারতেন । আমি যখন তাঁর দুঃখের কাহিনী পড়ি তখন আমার চোখ দিয়ে কান্না ঝরে পড়ে। তিনি, তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সঙ্গীরা স্বেচ্ছায় কতই না কষ্ট ভোগ করেছিলেন। তাই আমার মতো একজন সত্যাগ্রহী তাঁর মতো মানুষকে শ্রদ্ধা না করে থাকতে পারে না । যিনি তাঁর মনকে নিবদ্ধ রেখেছিলেন এক আল্লাহর প্রতি এবং তিনি চিরকাল হেঁটেছেন আল্লাহ ভীরুতার পথে। মানব জাতির প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল সীমাহীন। (Islam and its holy prophet as judged by the Non Muslim world, page- 20)
ইসলাম ডেস্ক
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ধর্ম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাতারা বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি করলেও তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ‘আত্মিক’ তথা নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষের আত্মিক তথা নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে মানবসমাজ তথা বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যেই মূলতঃ ধর্ম প্রতিষ্ঠাতারা ধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি ও বিকাশের প্রয়াস পেয়েছিলেন। ধর্মকে ‘বাণিজ্যিক’ বিষয়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধর্ম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। কিন্তু যুগের পরিক্রমায় মানুষেরা ধর্মকে ‘বাণিজ্যিক’ বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছেন। পুণ্যের ও স্বর্গ বা বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে মন্দির-মসজিদ নির্মাণের নামে শরিয়তপন্থিরা, মুরিদ বা অনুসারী বাড়ানোর নামে তরিকতপন্থিরা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার নামে রাজনীতিকরা ধর্মভীরুদের কাছ থেকে টাকা আহরণের কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন। ‘আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে পয়সা বা অর্থ না নেয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে পয়সা বা অর্থ আয়ের ব্যবস্থাস্বরূপ ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ নামে এক শিক্ষা-ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, হজ্ব-কোরবানি নিয়ে বাণিজ্য, মাজার বানিয়ে ওরশ করার নামে বাণিজ্য, পুজা-পার্বণ, ঈদ-রোজা, তাবলীগ জামায়াতের এস্তেমা, বড়দিন ইত্যাদি উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য ও যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানাভাবে মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায়ের প্রবণতাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার ধর্মকে ব্যবহার করে বড় বড় দেশগুলোর অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ‘অস্ত্র বাণিজ্য’ও চলছে পুরোদমে। পাশাপাশি ধর্মীয় সম্পদায়ের মানুষের প্রিয় শব্দ দ্বারা ব্যাংক-বীমা জাতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে মানুষকে ঠকানোর বা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আয় করা লোকের সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নয়। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ধর্মভীরু মানুষের কাছ থেকে টাকা আহরণের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই যেন ধর্ম-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাকারীরা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে গেছেন। এতে করে মানুষকে শান্তিবাদী, নীতিবান ও আদর্শবান করে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রয়াস নিয়ে ধর্ম-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাকারীরা ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্য বর্তমানে খুব কমই পূরণ হচ্ছে। পক্ষান্তরে যারা ‘বাণিজ্যিক’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধর্মকর্ম করছে, তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ কমে গিয়ে এমন এক উগ্রতাবোধের জন্ম হয়েছে যে, কেউ তাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সমালোচনা করলে তারা ‘বন্য মহিষের’ রূপ ধরে ‘বুনো শিং’ নিয়ে তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে, পাছে তাদের ধর্ম নিয়ে বাণিজ্যের পথ না বন্ধ হয়ে যায়Ñ সেই আশঙ্কায়। ধর্ম নিয়ে ‘বাণিজ্যের পথ’ বন্ধ হবার আশঙ্কা না থাকলে কেউ কারো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সমালোচনা করলে তাতে কারো কোনো অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়। কিন্তু ধর্মকে বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে যুগে যুগে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে। ইসলাম ধর্মও এই প্রচেষ্টার বাইরে থাকেনি।উৎস:
ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণে শিয়া ও সুন্নী দুইটি প্রধান দলে বিভক্ত মুসলিমরা। এই মতভেদের ইতিহাসটা কি তা অনেকেরই অজানা, বিশেষ করে সুন্নী দলভুক্তদের কাছে। আর শিয়া দলভুক্তরা যা জানে, তা যদি সত্য হয়Ñ তবে বলতে হয়Ñ রাসুল মোহাম্মদের (সাঃ) ওফাতের পর তাঁর শরীর মাটির নিচে ঢোকার আগেই ইসলাম ধর্ম কবরস্থ হয়ে গেছে।
ঢাকার ২৬ বাংলাবাজারস্থ র্যামন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশ্তী রচিত ‘মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ’ বইটি পড়ে মতভেদের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে এ রকমÑ
বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে ১৮ জিলহজ্ব তারিখে ‘গাদিরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে হজরত আলী (আঃ)কে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য পূর্বেই রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) কে প্রদত্ত এক নির্দেশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে “হে রাসুল, আপনার রব হইতে যাহা নাজেল করা হইয়াছে তাহা পৌঁছাইয়া দিন। আর যদি তাহা না করেন, তাহা হইলে তাঁহার (আল্লাহর) রেসালত পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল না। আল্লাহ আপনাকে মানবমণ্ডলী হইতে লইয়া আসিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের দলকে হেদায়েত করেন না” (৫ঃ৬৭) কোরআনের সব শেষের আগের এই আয়াতটি নাজেল করিয়াছিলেন। এই আয়াত নাজেল হবার পর রাসুল (সাঃ) সেখানেই থামিয়া গেলেন এবং বাহন হইতে নামিয়া গেলেন। কাফেলার অগ্রবর্তী এবং পশ্চাদবর্তী সকলকে একত্র করিয়া সেখানেই আলী (আঃ) এর অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদন করার ব্যবস্থা করিলেন (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৩)। উটের উপরে বসার কয়েকটি আসন একর পর এক স্থাপন করে মিম্বার তৈরি করা হলো। তার ওপর উঠে রাসুল (সাঃ) জনতার কাছে অবতীর্ণ বাণী পেশ করলেন এবং বললেনÑ আমি কি তোমাদের আপন জীবন হতে অধিক প্রিয় নই? উত্তরে লোকেরা বললÑ হাঁ হাঁ ইয়া রাসুলুল্লাহ। জনগণ হতে এই স্বীকৃতি লাভের পর তিনি আলী (আঃ) এর দুই বাহু ধরিয়া জনতার সম্মুখে তাঁকে শূন্যে তুলে ধরলেন এবং বললেনÑ “আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর যে তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাকে শক্রুরূপে গ্রহণ কর যে তার সঙ্গে শক্রুতা করে এবং সাহায্য কর তাকে যে সাহায্য করে এবং লাঞ্ছনা দাও তাকে যে লাঞ্ছনা দেয়।” তখন হজরত ওমর (রাঃ) সহ উপস্থিত সকলেই নবনিযুক্ত নেতার কাছে গিয়ে বায়াত গ্রহণ করেন। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৪)
হজরত আলী (আঃ) এর নিকট উপস্থিতদের বায়াত গ্রহণের অনুষ্ঠানপর্ব শেষ হলে তখন নাজেল হয় কোরআনের শেষ আয়াত যার বঙ্গানুবাদ হচ্ছেÑ ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ (৫ঃ৪)। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৪)
ওপরোক্ত বর্ণনা অনুুযায়ী এটা পরিষ্কার যে, রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের পর ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব হজরত আলী (আঃ) এর ওপরই অর্পিত হয়েছিল। কিন্তু রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই হজরত আবু বকর (রাঃ), হজরত ওমর (রাঃ), হজরত ওসমান (রাঃ) সহ অনেক সাহাবী (যারা মূলত উমাইয়া বংশীয়) হজরত আলী (আঃ) এর বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। এ প্রসঙ্গে ওপরোক্ত বইয়ের ১২১-১২২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছেÑ “সেদিন [রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের দিন] মদিনায় গোলযোগের সৃষ্টি হইল। মাওলার বিরোধী দল মদিনা ত্যাগ করিয়া বনি সাকিফায় চলিয়া গেল এবং সেখানে উপস্থিত লোকজনেরা মিলিয়া একপ্রকার নির্বাচন করিয়া আবু বকরকে খলিফা নিয়োগ করিল। এই নির্বাচনের মধ্যে কিছু সংখ্যক আনসারও অংশগ্রহণ করিয়াছিল। নির্বাচন একেবারে নির্বিবাদে সম্পন্ন হয় নাই। কারণ এই নির্বাচন সম্পন্ন করিতে দীর্ঘ তিন দিন অতিবাহিত হইয়াছিল। যাহা হোক, রাসুলের দেহত্যাগের তৃতীয় দিবসে আবু বকর খলিফা নির্বাচিত হইয়া দলবল লইয়া মদিনায় ফিরিতেছেন।
এদিকে হাসেমীগণ এবং মদিনার আনসারগণ নবীর বিয়োগে শোক-সন্তপ্ত অবস্থায় অভিভূত হইয়া পড়েন এবং তৃতীয় দিবসে আলীর নেতৃত্বে রাসুলুল্লাহর কাফন দাফন সম্পন্ন করেন। নির্বাচিত খলিফা তাহার দলবল লইয়া মদিনা প্রবেশের পূর্বেই জানিতে পারিলেন যে, রাসুলুল্লাহর দাফন ক্রিয়া সম্পন্ন করা হইয়া গিয়াছে। তাহারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন কবর হইতে উঠাইয়া রাসুলুল্লাহর দেহ পুনরায় তাহারা তাহাদের ইচ্ছামত দাফন করিবেন। ইহার উদ্দেশ্য অন্য কিছুই নহে। নেতার দাফনক্রিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার এবং সর্বপ্রকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভাব নিহিত থাকে। তাহাদের এইরূপ সিদ্ধান্তের কথা জানিতে পারিয়া আলী তাঁহার জুলফিকার লইয়া মাটির কবরের উপর বসিয়া পড়িলেন তাহাদিগকে এই কাজে বাধা দেওয়ার জন্য। তাহারা নিকটে আসিয়া একে অন্যের মুখ চাহিতে লাগিল। তখন ওমর আবু বকরকে লক্ষ করিয়া বলিলেন: ‘আপনি আমাদের নির্বাচিত খলিফা, হুকুম করুন, আমরা আলীকে আক্রমণ করি।’ আবু বকর খানিক চিন্তা করিয়া বলিলেন: আমি রাসুলুল্লাহকে বলিতে শুনিয়াছিঃ ‘এমন সময় আসিবে যখন আলী মাটির ঘোড়ায় সওয়ার হইবেন তখন যে-ই তাহার মোকাবিলা করিবে সে কাফের হইয়া মারা যাইবে।’ আমার মনে হয় ইহাই সেই মাটির ঘোড়া। এইরূপে তাহারা তাহাদের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করিল।” (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১২১-১২২)
ওপরোক্ত গ্রন্থের ৮৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেÑ “রাসুলের এন্তেকালের প্রায় ২১ বৎসর পরে খেলাফত কোরানের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা সংকলন করেন। এত বিলম্ব করিয়া প্রকাশ করার অন্যতম প্রধান একটি কারণ ছিল মাওলাইয়াতের বিরুদ্ধে এবং আহলে রাসুলের বিরুদ্ধে তাহাদের এই প্রকাশনাকে সাজাইয়া লওয়া। কি বাদ দিতে হইবে এবং কেমন করিয়া সাজাইতে হইবে ইত্যাদি নানারূপ বিষয় ছিল তাহাদের চিন্তার বিষয়। ক্ষমতা ও পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া উপযুক্তভাবে উহার প্রকাশ পরিচালনা করাÑ যাহাতে জনমতে কোনরূপ বিদ্রোহ প্রকাশ না পায়। এত সাবধানতা সত্ত্বেও দেখা গেল কোরান সংকলন হজরত ওসমানের পতনের সর্বপ্রধান কারণ হইয়া দাঁড়াইল।” (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ৮৩)
ওপরোক্ত গ্রন্থের ৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছেÑ “ইমাম বাকের (আঃ) বলিয়াছেন, তিন শতের উপর কোরানের বাক্য ‘তাহরীফ’ অর্থাৎ ‘বদল’ করা হইয়াছে যাহা আহলে বাইতের শানে ছিল।” বদলকৃত বাক্যের কিছু নমুনাও বইটিতে তুলে ধরা হয়।
বইটির ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় এ রকম একটি নমুনা দেয়া হয় যাতে কোরানের সর্বশেষ আয়াতটিকে খেলাফত সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে যে বসিয়েছে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। কোরানের ৫ নম্বর সুরার ৪ নম্বর আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছেÑ “তোমাদের জন্য (খাদ্য হিসাবে) হারাম করা হইয়াছে শব এবং রক্ত এবং শুকরের মাংস এবং যাহা আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে উৎসর্গিত হইয়াছে এবং গলা চাপিয়া মারা (জন্তু) এবং প্রহারে মৃত (জন্তু) শৃংগাঘাতে মৃত (জন্তু) এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া (জন্তু)Ñ তবে জবেহ দ্বারা যাহা পবিত্র করিয়াছ তাহা ব্যতীত এবং যাহা (মূর্তি পূজার) বেদীর উপর জবাই দেওয়া হয় এবং জুয়ার তীর দ্বারা অংশ নির্ণয়কৃত মাংস। এই সবই ফাসেকী।” এরপর কোরানের সর্বশেষ অবতীর্ণ বাক্যটি এখানে সংযোজিত করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছেÑ ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ এরপর আবার খাদ্য সংক্রান্ত বাক্য “সুতরাং যে ব্যক্তি পাপের দিকে ঝুঁকিয়া নয়, ক্ষুধায় কাতরÑ তাহা হইলে নিশ্চয় আল্লাহ (তাহার প্রতি) ক্ষমাশীল রহিম।”(৫ঃ৪)
কোরআনের শেষ অবতীর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ এই অহি বাক্যটি যাহা গাদিরে খুমে অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা এমন জায়গায় স্থাপন করা হইয়াছে যাহাতে ইহাই বোঝা যায় যে, কেবলমাত্র খাদ্যের ভাল মন্দ (এই আয়াতের নির্দেশমতে) বিচার করিয়া খাইলেই ধর্ম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এই আয়াতটি হইল খাদ্য বাছাই করা বিষয়ে একটি সাধারণ ব্যবস্থা। অথচ মধ্যবর্তী কথাটি ইহাতে স্থাপন করাতে মনে হয় দেখিয়া শুনিয়া খানা খাইলেই দ্বীন কামেল হইয়া যায় অর্থাৎ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হইয়া যায়। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ৬-৭)
ওপরোক্ত গ্রন্থের ৬-৭ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত ওপরোক্ত যুক্তিই এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, হজরত আলীকে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর মদিনার রাষ্ট্রভার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা অপর খলিফারা এ সংক্রান্ত কোরানের অপর আয়াতগুলি বাদ দিয়ে ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ এই বাক্যটিকে কোথায় বসাবে সেই দিশা না পেয়ে হালাল খাবার সংক্রান্ত আয়াতসমূহের ভেতরেই ওপরোক্ত এই আয়াত ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ওপরোক্ত গ্রন্থটিতে ইসলামের প্রধান দুটি দল শিয়া ও সুন্নীর মধ্যে বিভেদের বিষয়ে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটিও এসে যায় যে, ইঞ্জিল শরীফ বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে তা যদি আর মানুষের জন্য অনুসরণযোগ্য গ্রন্থ না থাকে, তবে ক্ষমতালাভ ও ভোগের স্বার্থে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা কোরানের যে বিকৃতি ঘটিয়েছে (ঢাকার ২৬ বাংলাবাজারস্থ র্যামন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশ্তী রচিত ‘মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ’ গ্রন্থের ওপরোক্ত বক্তব্য মতে) অন্যকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে, সেই বিকৃত কোরান কি মানুষের জন্য আর গ্রহণযোগ্য থাকে? তা-ও কি ইঞ্জিল শরীফের মতো বাতিলযোগ্য গ্রন্থ হয়ে যায় না? আর কোরান বাতিলযোগ্য গ্রন্থ হলে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের কোরান নিয়ে ধর্ম বাণিজ্যের কোন সুযোগ কি থাকে? আর কোরান যেহেতু বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যেই বিভেদের বড় কারণ এবং এই বিভেদে মসজিদে বোমা হামলা ঘটে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে অহরহ, তাই তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ধর্মবাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে রচিত মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী এই গ্রন্থ দিয়ে কোন মুসলিম যেন রাজনীতি করতে না পারে, সেদিকে মুসলিমদেরই সতর্ক থাকতে হবে বেশি।
"সকল ধর্মের মূল উৎস এক; পৃথিবীর মানুষ এক পরিবার" দেশ বরেণ্য বিজ্ঞানী ও ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ড. এম শমশের আলীর এই আলোচনা আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।




"হে মানুষ শোনো!" সিডির অডিও গুলো ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন অথবা এখানে ক্লিক করুন।
আলোচনার অংশ-বিশেষ ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন।
সূত্র: কোয়ান্টাম বুলেটিন (আগষ্ট ২০১১)
হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জনের ফলে সমাজ ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের মাঝে সুষম ভারসাম্য ফিরে আসে; কৃষক দিন মজুর, ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিক-মালিক এবং অধস্তনদের সাথে উর্ধ্বতনদের সুদৃঢ় ও সংগতিপূণ সর্ম্পক তৈরী হয়। ফলে সকল শ্রেণীর নাগরিকই তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় এবং সমাজ সংসারে নেমে আসে শান্তির সুবাতাস।
মূলত: ইসলাম যে পেশাকে অবৈধ বলে ঘোষনা করেছে সেসব পন্থায় উপার্জন ব্যতীত অন্যান্য পন্থায় উপার্জন করা বৈধ বলে বিবেচিত। ইসলাম প্রদত্ত সীমারেখা ও মূলনীতি ঠিক রেখে বৈধ যে কোন পণ্যের ব্যবসা করার মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলামী শরী‘আত হালাল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যদি কেউ বৈধ উপায়ে যোগ্যতানুযায়ী চাকুরী করে এবং ঘুষ সহ যাবতীয় অবৈধ লেন-দেন ও অসৎ মানসিকতা থেকে দুরে থাকে তবে সেটাও জীবিকার্জনের হালাল পন্থা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এটি শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রোযা, যাকাত প্রভৃতির উপরই সীমাবদ্ধ নয়। জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ রেখার প্রণেতা হিসেবে ইসলামে রয়েছে জীবন ধারনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা। এ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা গ্রহণও অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়, ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«كسب الحلال فريضة بعد الفريضة »
‘‘ফরয আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরয।’’
উপর্যুক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব কতখানি এবং কোন ব্যক্তি যেন হারাম কোন পেশা অবলম্বন না করে উপরোক্ত হাদীসে সে মর্মেও অর্ন্তনিহীত নির্দেশ রয়েছে। পরকালীন জীবনে এ ফরয ইবাদতটি সম্পর্কে যে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা যাবতীয় ফরয সম্পর্কে বান্দা জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব এটি ফরয কাজ সমূহের অন্তর্গত এক মৌলিক অত্যাশ্যকীয় ইবাদতে গণ্য হয়েছে।
উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব পন্থাকে হালাল করেছে সেগুলোর মূলনীতিসহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো:
১.১ ব্যবসা বাণিজ্য
উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সব চেয়ে বড় সেক্টর। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মহৎ পেশা। সমাজ জীবনে যার ক্রিয়াশীলতা ও প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূঢ় প্রসারী। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে শুধু বৈধ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এ ব্যাপারে সবিশেষ উৎসাহ ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেন মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর বুকে একটি শ্রেষ্ট জাতি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি ও স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন:
﴿وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ﴾[البقرة:275]
‘‘তিনি (আল্লাহ) ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’’
উপরোক্ত আয়াতের মর্ম উপলব্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, সুদভিত্তিক লেন-দেনের মাধ্যমে যারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করছে তাদের মুকাবিলায় মহান আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ বলে ঘোষনা দিয়েছেন। অতএব অবৈধ পন্থা হতে বাঁচার এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি লাভের এটি অনেক বড় অবলম্বণ। এছাড়াও জীবিকার একটি বৃহৎ অংশ রয়েছে এ ব্যবস্থাপনায়। মুরসাল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
«عليكم بالتجارة فإن فيها تسعة أعشار الرزق»
‘‘তোমরা ব্যবসা বানিজ্য কর। কারণ তাতেই নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা’’
তাছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়নতা, ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক হাদীস বিদ্যমান। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে তিনি নবীগণ, ছিদ্দিক, ও শহীদদের সমমর্যাদাপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«التاجرالصدوق الأمين مع النبيين والصديقين والشهداء»
‘‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব মূলনীতি দিয়েছে তাহলো: ধোঁকা ও প্রতারনামুক্ত, মিথ্যার আশ্রয় বিহীন, পণ্যের দোষ - গুণ স্পষ্ট থাকা, ভাল পণ্যের সাথে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ না করা, মুনাফাখোরী মানোবৃত্তি পরিহার করে কল্যাণমুখী মানষিকতা পোষণ, মজুদদারি চিন্তা-চেতনা পোষণ না করা, ওজনে হের-ফের না করা, সর্বোপরি যাবতীয় শঠতা ও জুলুম থেকে বিরত থাকা।
১.২. চাকুরী
এটি জীবিকা নির্বাহে উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের দেশে সরকারী আধা-সরকারী, বেসরকারী, ব্যাংক-বীমা, এন.জি.ও. ও ব্যক্তিমালিকানাধিন এবং স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। এসব চাকুরীর ক্ষেত্রে ইসলামের মূল দর্শন হলো প্রত্যেক চাকুরে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সচ্ছতার সাথে পালন করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
«كلكم راع، وكلكم مسئول عن رعيته »
‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’’
তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সকলকে যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি অন্যায়ভাবে কাউকে সুযোগ সুবিধা (undue Facilities) দান, কারো প্রতি জুলুম করা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি-পরায়ণদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও কর্তব্যে অবহেলা, অনিয়মানুবর্তিতা ও কার্যে উদাসীনতার দরুন চাকুরীজীবিদের উপার্জন অনেক সময় বৈধতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠ দানের পরিবর্তে টিউশনী ও কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশী ঝুকে পড়েছেন। অনেক ডাক্তার হাসপাতালে রোগী না দেখে ক্লিনিকে জমজমাট ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। যা কর্তব্যে অবহেলার নামান্তর। তারা যদি স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ ও পূর্ণভাবে পালন করার পর অতিরিক্ত সময় এসব কাজ করেন তবে তা দোষের নয়।
১.৩.কৃষিকর্ম
কৃষিকর্ম জীবিকা নির্বাহে অন্যতম উপার্জন মাধ্যম। ইসলাম এটিকে মহৎ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষিকার্যের সুচনা হয়েছে আদিপিতা আদম আলাইহিস সালাম থেকেই তাঁকে কৃষি কার্য, আগুনের ব্যবহার ও কুটির শিল্প শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে এ ব্যবস্থাকে সাব্যস্ত করেছেন।
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ লোকই কৃষি নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ ইসলামের কৃষিনীতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কেউ তাঁর এ ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নীতি অনুসরণ করে তবেই তা হালাল উপার্জন হবে। আর সেগুলো হলো:
ক. ভূমির মালিক নিজেই চাষ করবে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«من كانت له أرض، فليزرعها»
‘‘যার জমি রয়েছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে।’’ তবে এক্ষেত্রে কারো জমি অন্যায়ভাবে অধিকারে আনে কিংবা উত্তরাধিকারকে অংশ না দিয়ে চাষ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
অথবা, মজুরের দ্বারা নিজের তত্বাবধানে চাষ করবে অথবা কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ ও ভোগদখল করতে দিবে।
খ. উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার শর্তে কাউকে চাষ করতে দেয়া।
গ. প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকার বিনিময়ে কাউকে এক বছরের জন্য তার ভোগাধিকার দান করা।
ঘ. জমিতে হারাম দ্রব্য উৎপাদন না করা, যাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান রয়েছে্ যেমন: আফিম, গাঁজা, চারস বা অনুরূপ মাদক দ্রব্য।
ঙ. অংশীদারিত্ব চাষাবাদ যাবতীয় প্রতারণা, ধোঁকা, ঠকবাজি, ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত থেকে ন্যায়পরায়নতা ও ইনসাফ ভিত্তিক নীতির লালন করতে হবে।
আল্লামা মাওয়ারদী উল্লেখ করেছেন যে, উৎপাদনের মূল উপাদান দু’টি, এক. কৃষি, দুই. ব্যবসা-বানিজ্য। তবে এদুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম হলো কৃষি।
ইসলামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লাভের তিনটি নৈতিক পন্থা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে।
আর তা হলো:
১. পরিশ্রম:
পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ অর্থ সম্পদ উপার্জন করতে পারে। সে সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে মানুষ অর্থের পাহাড় গড়তে সক্ষম হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আল্লাহর নিকট ঐ জীবিকাই উত্তম যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জন করে। এভাবে শ্রমদানের ক্ষেত্রও বহুবিধ ও বিচিত্র ধরনের। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. শিল্পকর্ম:
ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্পকর্মও মানুষের অন্যতম পেশা। এ মহতি পেশায় জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত রয়েছে। এ কর্মটি সম্পর্কে ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্বরোপ করেছে। যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ শুধু উৎসাহের বানী প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি; বরং শিল্প ও ব্যবসার ময়দানে তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:
﴿وَعَلَّمۡنَٰهُ صَنۡعَةَ لَبُوسٖ لَّكُمۡ لِتُحۡصِنَكُم مِّنۢ بَأۡسِكُمۡۖ فَهَلۡ أَنتُمۡ شَٰكِرُونَ ٨٠﴾ [الأنبياء: 80]
‘‘আমি তাঁকে (দাউদ আলাইহিস সালাম) বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে।’’
শিল্প শিক্ষাকে মহান আল্লাহ নিয়ামত হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এ-জন্য শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর নবীগণ কোন না কোন শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। উপরোক্ত আয়াতে দাউদ আলাইহিস সালাম বর্ম শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন বলে আভাস রয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রথম জীবনে চাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি শষ্য বপন ও কর্তন করতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে জমি মানুষের খিদমতের জন্য কোন কাজ করে তাঁর দৃষ্টান্ত মূসা আলাইহিস সালাম জননীর ন্যায়। তিনি নিজে সন্তানকে দুধ পান করিয়েছেন; আবার ফেরাউনের কাছ থেকে পাবিশ্রমিক পেয়েছেন। এছাড়া মূসা আলাইহিস সালাম মাদইয়ানে ৮ বছর চাকরী করছেন, নূহ আলাইহিস সালাম জাহাজ নির্মান করেছেন। যাকারিয়া আলাইহিস সালাম কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাল্যকালে ছাগল চরাতেন, যৌবনে ব্যবসা করেছেন, চাকরী করেছেন, খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন, মাথায় বোঝা বহন করেছেন। কূপ থেকে পানি তুলেছেন, নিজ হাতে জামা ও জুতা সেলাই করেছেন, স্ত্রীকে ঘরে রান্নার কাজে সাহায্য করেছেন, এমনকি দুধ দোহনও করেছেন। এজন্য পেশা ক্ষুদ্র হোক, বৃহৎ হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। নিজে পরিশ্রম করে শ্রমলব্দ আয়ে নিজের পরিবারবর্গের আস্বাদনের জন্য সংগ্রাম করা অতিশয় সম্মান ও পূণ্যের কাজ।
২. উত্তরাধিকার:
উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ অর্থ সম্পদ লাভ করে থাকে। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিগণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী মৃতের পরিত্যক্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি হতে যে সম্পদ লাব করে থাকে তা হালাল।
৩. হেবা বা দান:
কোন বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান ব্যাতিরেকে কাউকে নিজের সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর বা দান করা এবং যার অনুকুলে হস্তান্তর বা দান করা হয় সে ব্যাক্তি কর্তৃক তা গ্রহণ করাকে হেবা বলা হয়। হেবার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সম্পদ হালাল।
সূত্র: ইন্টারেনট থেকে অনুদিত ও সংকলিত।
আরো শুনে রাখ মানবদেহে এমন একটি অংশ রয়েছে যে, সেই অংশটি যখন যথার্থভাবে ঠিক হয়ে যায়, তখন মানুষের পূর্ণ অস্তিত্ব ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মানবদেহটিই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে সেই অংশটি যখন খারাপ হয়ে পড়ে, তখন সমস্ত অস্তিত্বটিই খারাপ হয়ে যায়। অর্থাৎ মানব দেহের কোনো অংশ বা কোনো অঙ্গই তখন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় না। খুব ভালো করে জেনে নাও সে অংশটি হুে ছ মানুষের বিবেক।
বিশ্লেষণ : শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকাম চার প্রকার দলিল ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় । কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। এর যে কোনো একটি দ্বারা যে কোনো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ‘হালাল’ বৈধ ও গ্রহণীয় বলে প্রমাণিত হবে যে এটিই হালাল এবং যে কোনো বিষয় সুষ্পষ্টভাবে ‘হারাম’ নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় বলে প্রমাণিত হবে তা হারাম।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে হালাল এবং হারাম অতি স্পষ্ট এবং এই সকল দলিল, প্রমাণ ও মাপকাঠি দ্বারা উভয়টিকে বেছে নেয়া অত্যন্ত সহজ। অধিকন্তু এটিও স্পষ্ট যে, হালালকে গ্রহণ করা যাবে এবং হারামকে বর্জন করতে হবে। এতে বিন্দুমাত্রও নড়চড় করার অবকাশ নেই। কিন্তু হালাল ও হারাম পর্যায়দ্বয়ের মধ্যবর্তী আরো কিছু পর্যায় রয়েছে। যথা মাকরূহ, খেলাফেআওলা বা অবাঞ্ছনীয়, ইমাম ও খাঁটি ওলামাদের মতোবিরোধমূলক বিষয়াদি।
এতদ্ব্যতীত এমন আরো বহু বিষয়াদি আছে যা শরিয়তে লিপিবদ্ধ আছে এবং তা ছাড়াও দৈনন্দিন কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে প্রায়শই এমন বিষয়াদি আমাদের সম্মুখবর্তী হতে থাকে যা নির্দিষ্টভাবে হালাল বলেও নিশ্চিত হওয়া যায় না, কিংবা হারাম বলেও স্থির করা যায় না এ সকল অনিশ্চিত ও সন্দেহভাজন বিষয়গুলোকে সযত্মে পরিহার করে চলাই একান্ত বাঞ্ছনীয়। কেননা এ সমস্ত সন্দেহজনক বিষয়বস্তুসমূহ থেকে বিরত থাকলে এক দিকে জাগতিক ব্যাপারে যেমন লাভবান হওয়া যায়, কারণ সন্দেহের স্থানে পা রাখলেই স্বীয় মান-মর্যাদা কলুষিত হওয়ার এবং নানা প্রকার কুৎসা রটানোর সুযোগ উপস্থিত হয়।
অন্যদিকে তেমনি দীনের ব্যাপারেও লাভের সীমা থাকে না। কারণ যে ব্যক্তি স্বীয় নফ্স ও প্রবৃত্তিকে সন্দেহের স্থান থেকে বিরত রাখতে অভ্যস্ত হবে, সে নিশ্চয় যাবতীয় কুপ্রলোভনের বস্তু থেকে এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে স্বীয় নফ্সকে ফিরিয়ে রাখতে সক্ষম হবে।
হারাম ও সন্দেহভাজন কাজ থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম নিজের বিবেককে যথার্থভাবে সুষ্ঠু ও ঠিক করতে হবে। কারণ মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য বৈদ্যুতিক মটর স্বরূপ। মটর ঠিকভাবে চালু থাকলে কারখানার প্রতিটি শাখা তার প্রতিটি অংশ ও সমস্ত কল-কবজার চাকাগুলো রীতিমত চলতে থাকবে। আর মটরে গোলযোগ থাকলে তার সংযোগ রক্ষাকারী সমস্ত মেশিন ও তার অংশগুলোর মধ্যেও গোলযোগ দেখা দিবে। অবশ্য মটরের সঙ্গের চাকাগুলো সক্রিয়সংযোগ রক্ষার প্রতিও তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে মেশিনের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সংযোগবিহীন শুধু মটর চালালে উদ্দেশ্য সফল হবে না এবং এ ধরনের নিরর্থক ও অনিয়মিত পরিচালনার ফলে কারখানা ফেল হয়ে যাবে। অতএব মেশিনের সমস্ত কল-কবজা ও তার বিভিন্ন অংশগুলোকেও রীতিমত চালু রেখে মোটরের প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, তার ভাল-মন্দের প্রভাব সমস্ত কারখানার ওপর পড়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষের কর্তব্য তার বিবেক-বুদ্ধিকে সুষ্ঠু করে তার পর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেক দ্বারা স্বীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা।
দেহ আলোচনা
উপরোক্ত হাদিসের শেষ বাক্য ‘আলা ইন্নাফিল জাছাদে মুজগাতান’ মানবদেহের মধ্যে একটি বিশেষ অংশ আছে যার উন্নতি-অবনতির উপর সম্পূর্ণ দেহের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করে। এ তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টি তত্ত্ব ও দেহ-তত্ত্বের ইঙ্গিত দানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে, স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষè আত্মার উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মুখ্য উন্নতি নির্ভর করে। আত্মার উন্নতি সাধিত না হলে মানব জীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
মানুষের অজুদ বা অস্তিত্ব দুই ভাগে বিভক্ত স্থুলদেহ’ যা বাহ্য দষ্টিতে বা যান্ত্রিক সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে থাকে এবং ‘সূক্ষèআত্মা’ যা ঐরূপে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হতে পারে না। মানুষের স্থুলদেহ সৃষ্টির মূলে যেমন বিভিন্ন উপাদান রয়েছে যথা পানি, মাটি, বায়ু ও অগ্নি তেমনি তার এ ভৌতিক দেহাভ্যন্তরে পাঁচ প্রকারের আত্মাও রয়েছে। যথা
১। পশুর আত্মা, যা দ্বারা খাওয়া শোয়া, কামরিপু চরিতার্থ করা ইত্যাদি প্রবৃত্তির উদ্রেক হয়।
২। হিংস্র জীবের আত্মা : যা দ্বারা দ্বেষ, হিংসা, ক্রোধ ও রাগের বশীভূত হয়ে মারামারি কাটাকাটি করত: প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তি জন্মে থাকে।
৩। শয়তানের আত্মা : যার প্ররোচনায় পাপাচার, অহঙ্কার, মিথ্যা ও সূক্ষ্ম কূট-কৌশলের দ্বারা মানুষকে ধোকা দেয়া ইত্যাদির প্রবৃত্তি উদিত হয়।
৪। ফেরেশতা আত্মা : যা দ্বারা সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, সত্যতা, পরোপকারিতা ও আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করা ইত্যাদির আগ্রহ ও আকর্ষণ জন্মে থাকে।
৫। মানুষের আত্মা : যার কর্তব্য হুে ছ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আত্মাকে বশ করত: তাদেরকে কুপ্রবৃত্তির দিক থেকে ফিরিয়ে দিয়ে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে গুণান্বিত ও পরিচালিত করা এবং আল্লাহর মারেফত ও মহব্বত হাসিল করত: দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত তথা আল্লাহর হুকুম আহকাম জারির পরিবেশ কায়েম করার আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করা।
প্রথম তিনটি আত্মাকেই তাসাওফের পরিভাষায় ‘নফসে আম্মারা’ বলা হয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম এ দুটিকে রূহ, আ’ক্বল বা লতিফা বলা হয় এবং এটিই হুে ছ বিবেক, বুদ্ধি ও মানবাত্মা।
দেখা গেল যে, এই পাঁচ প্রকারের আত্মাই তাসাওফের পরিভাষায় দুই নামে পরিচিত হয়েছে। একটি হল নফসে আম্মারা; এর তিনটি বিভাগ যথা পশুরআত্মা, হিংস্রজন্তুরআত্মা ও শয়তানেরআত্মা। দ্বিতীয়টি হলো রু হ অর্থাৎ মানবাত্মা বা বিবেক -আকল। এর দুটি বিভাগ যথা ফেরেশতার আত্মা ও মনুষত্বেরআত্মা।
রাসূল সা. ‘আলা ইন্না ফিল জাছাদে মোজগাতান’ বলে মানব দেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি নির্দেশ করেছেন, সে অংশটিই হুে ছ রু হ বা আকল-বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে; এটাই রাসূল সা. বলেছেন রু হ বা জ্ঞান-বিবেক রত্মটির উন্নতি হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং এর অবনতিতে সমগ্র মানবদেহের অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে, এই অংশটির উন্নতির অর্থ কী? বস্তুত প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতির বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দ্বারা। তাই এখন দেখতে হবে যে রু হ বা বিবেকের উপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর অতি সহজ। কারণ, রু হ মানবাত্মা বা বিবেক বলে যে দুটি আত্মার নামকরণ হয়েছিল অর্থাৎ ফেরেশতাআত্মা ও মনুষ্যত্বের আত্মা তাদের কর্তব্য ছিল সদাচার, সততা, সভ্যতা ও আল্লাহর বশবর্তীতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফস নামে যে অপর তিনটি শক্তি বা আত্মা আছে তাদেরকে বশে এনে ফেরেশতা আত্মার সদগুণাবলীতে পরিচালিত করা। অতএব রু হ বা বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তাই হবে। এ মহান কর্তব্য পালনে রু হ মানবাত্মা বা বিবেক যতোটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণমানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। এমনকি অবশেষে এই রু হ মানবাত্মা যে উর্দ্ধজগত থেকে এসেছিল পুনরায় সে মানবদেহকে নিয়ে সেই উর্দ্ধজগতে অর্থাৎ বেহেশতে গিয়ে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে রূহ মানবাত্মা নিজের ঐ কর্তব্যে ত্রু টি করত: নিজেই যদি নফস তথা ঐ তিন প্রকার আত্মার বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তা হলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির তিমির গর্তে পতিত হবে। অবশেষে ঐ রু হ মানবাত্মা মানবদেহকে নিয়ে সর্ব নিু জগতে তথা জাহান্নামে পৌঁছাবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদগণ রু হ বা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করেছেন। পূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়ে ছিল যে, রু হ মানবাত্মা বা আকল ও বিবেককে তাসাওফের পরিভাষায় লতিফা নামেও নামকরণ হয়ে থাকে। সেই অনুসারেই রু হের উন্নতির পাঁচটি স্তরের নিুলিখিতরূপে নামকরণ করা হয়েছে।
১। লতিফায়েকলব : মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহর নাম উু চরণ করত: জিকির করে তখন সে এ লতিফায়ে কালবের কর্তব্য পালন করে।
২। লতিফায়ে রু হ : মানুষ যখন আল্লাহর মহৎ গুণাবলীর ধ্যান করে এবং এই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যেও ঐ গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করে, যেমন : আল্লাহ দয়ালু, দয়াময় এর ধ্যান করত: এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যে, আমাকেও দয়ালু হতে হবে এবং দয়ালুর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে তখন হয় লতিফায়ে রু হের কর্তব্য পালন।
৩। লতিফায়ে সের্র : মানুষ যখন আল্লাহর গুণাবলীর প্রতিবিম্ব নিজের মধ্যে হাসিল করায় সচেষ্ট হয় তখন তার সিনার অভ্যন্তরে আল্লাহর মারেফাতের বা আল্লাহর গুণাবলীর তত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূতহয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয় অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে, এটাই হুে ছ লতিফায়ে সের্র এর কর্তব্য।
৪। লতিফায়ে খফী মানুষের মধ্যে যখন আল্লাহর মা'রেফতের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন মানুষ আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভুত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণিত হয়ে যায় এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় এবং সেগুলোকে ফানা ও বিলুপ্ত করে দেয়। অর্থাৎ সেগুলোকে পূর্ণভাবে দখল ও অধিকার করার শক্তি ও সামর্থ অর্জন করে। এটাই হ্ছে লতিফায়ে খফীর কর্তব্য।
৫। লতিফায়ে আখফা : মানুষ ফানা-ফিল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহরগুণে গুণান্বিত হওয়ার মর্তবায় পৌঁছে, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে; এটাই হুে ছ লতিফায়েআখফার মর্যাদা। এ অবস্থাতেই রু হ বা বিবেক ও আকলের পূর্ণশুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পরে আর বিবেককে কুপ্রবৃত্তির বশীভুত হতে হয় না। রাসূল সা. মানুষকে বিবেক সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন তার উদ্দেশ্য হুে ছ মানবাত্মার পরম উন্নতিলাভ। সোনার বাংলাদেশ
প্রফেসর স্টিফেন হকিংয়ের নাম এতোই সুপরিচিত যে তাঁর কোনো পরিচিতি লাগে না। তারপরও কিছু বলা যায়। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর ছিলেন দীর্ঘ ৩০ বছর। এই পদে নিউটন একদা অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিজ্ঞানী হিসেবে হকিং কিংবদন্তীতুল্য। আইনস্টাইনের পরপরই জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর নামই সর্বাগ্রে মুখে আসে। নিন্দুকেরা বলতে পারেন যে তাঁর এই ‘ক্রেইজ’ মিডিয়ার কল্যাণে সৃষ্টি। কিন্তু তারপরও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে তাঁর অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।
সুপ্রসিদ্ধ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হকিং সম্প্রতি একটি সাড়া-জাগানো বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’। বইটি নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। এই বইটিতে তাঁর সহলেখক ছিলেন ক্যালটেকের পদার্থবিদ লেওনার্ড ম্লোদিনো। এই বইটি প্রকাশ পাবার সাথে সাথে এ নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে নানান বিতর্কের। বলা হয়েছে, হকিং সরাসরি ঈশ্বরকে নাকচ করে দিয়েছেন। হকিংয়ের এটাই একমাত্র বই নয়। এর আগেও তিনি বই লিখেছেন। এবং সাড়া জাগিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ (১৯৮৮)। এই বইটি সর্বমোট প্রায় নব্বুই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। বিজ্ঞানের বইয়ের জন্য এটা একটা সাংঘাতিক রেকর্ড। মহাবিশ্বের সৃষ্টি, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, মহাবিশ্বে কার্যকর প্রাকৃতিক নিয়মকানুন, মৌলিক কণার ব্যাখ্যা এসব নিয়েই তিনি ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’-এ লিখেছিলেন। তিনি সেখানে কৃষ্ণবিবর সংক্রান্ত তাঁর তত্ত্ব এবং পদার্থবিজ্ঞানের একত্রিকরণ সর্ম্পকেও লিখেছিলেন। তারপর তিনি লিখেছেন ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’ (২০০১)।
আগের বইগুলো থেকে বর্তমান বইটির চরিত্র বেশ আলাদা। এই বইয়ের ভাষা আরো সাবলীল। দৈনন্দিনের ভাষা ব্যবহার করে তিনি পাঠককে নিয়ে গেছেন আধুনিক গবেষণার একেবারে প্রান্তবিন্দুতে। ফলে অ-বিজ্ঞানী যে-কেউ বইটি নাড়াচাড়া করলে মহাবিশ্ব এবং তার মৌলিক চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। বইটিতে মোট আটটি অধ্যায়ে তিনি সত্তার রহস্য, বাস্তবতার স্বরূপ, সবকিছুর তত্ত্ব, মহাবিশ্বের গতি-প্রকৃতি, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আধুনিক চিন্তাধারা এবং মহাবিশ্বের মূল-নকশার বিষয় তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ আটটি অধ্যায়ের মোট দুইশ পাতায় পাঠক মানুষের চিরাচরিত জিজ্ঞাসার জবাব বিজ্ঞানের ভাষায় পেয়ে যাবেন। মজার ব্যাপার, এই অভিযাত্রায় তাকে কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্রেরই মুখোমুখি হতে হবে না। হকিংয়ের এই বইটির অনন্যতা এই দিক দিয়ে যে, এর ভাষা মোটেই ভারাক্রান্ত নয়। এমনকি হকিং নিজেই স্বীকার করেছেন যে ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ অত সহজ বই নয় যতটা দাবী করা হয়েছিল। আর তাঁর পরবর্তী ‘আ ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম’ (২০০৫) বইতে তিনি ‘ব্রিফ হিস্ট্রি’কেই সহজতর ভঙ্গীতে পুনরুপস্থাপন করেছেন। আর তাঁর ‘নাটশেল’ বইটি বেশ জটিল। কিন্তু সেসবকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে এই বইটি।তিনি কী লিখেছেন এ বইয়ে? বইটি শুরু হয়েছে তিনটি প্রশ্ন দিয়ে:
• মহাবিশ্বে শূন্যতার বদলে এতোকিছুর সমাহার দেখা যায় কেন? এক কথায়, মহাবিশ্ব শূন্য নয় কেন?
• আমাদের সত্তার রহস্য কী?
• আমরা ঠিক এইরকম ভৌতবিধি দেখি কেন, কেন অন্যরকম নয়?
তিনি বলেছেন ‘এটিই হলো জীবন, মহাবিশ্ব এবং সবকিছু সম্পর্কে চূড়ান্ত প্রশ্ন’ এবং এর উত্তর তিনি দেবার চেষ্টা করেছেন এ বইয়ে। তিনি আরো বলেছেন,‘বিশ্বকে গভীরভাবে বুঝতে হলে শুধু কীভাবে এটি আচরণ করছে তা জানাই যথেষ্ট নয়, জানতে হবে কেন ঠিক ঐভাবেই বিশ্বের বিবর্তন হচ্ছে।’
বইটির শুরুতেই তিনি চমক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন জগতের রহস্য কী, আমাদের সত্তার রহস্য কী, বিশ্বজগতের নিয়মাবলি কী, জগতের উৎপত্তি কীভাবে এসবই মানুষের চিরকালীন প্রশ্ন। যুগে-যুগে এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেক যুগে বিজ্ঞানীদের উত্তর পরবর্তী যুগে আরো শাণিত হয়েছে। আরো পূর্ণতা পেয়েছে। এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়েছে। যদিও এককালে এসব প্রশ্নের উত্তর দার্শনিকেরা দিতেন, কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরাই এসব প্রশ্নের যোগ্য উত্তরদাতা। আর আজকের দিনে, তিনি জানাচ্ছেন,‘দর্শনের মৃত্যু ঘটেছে।’ কারণ বিজ্ঞানের সাথে, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের সাথে, দর্শনের গাঁটছড়া সেই-যে কবে ছুটে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই চিরকালীন প্রশ্নের বাস্তবসম্মত উত্তর এখন পদার্থবিজ্ঞানীই দিতে পারেন। এখানেই আমি চমকে উঠি। আরে, একথাতো আমি আগেই শুনেছি ! কয়েকমাস আগে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমাদের দেশের এক বরেণ্য বিজ্ঞানী ঠিক একথাই আমাকে বলেছিলেন। তখনো হকিংয়ের বই বেরই হয়নি! গ্রেট সায়েন্টিস্ট্স থিংক অ্যালাইক কী বলেন !
অ্যারিস্টটলের সময়ে বিশুদ্ধ চিন্তা দিয়ে জগতের সকল রহস্যের সমাধান করার প্রচলন ছিল। শুধু চিন্তা দিয়ে যে জগতের রহস্যের কুলকিনারা পাওয়া যায় না সেটা বহুকাল পর গ্যালিলেও এসে প্রমাণ করলেন। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে ভারী বস্তু হাল্কা বস্তুর তুলনায় দ্রুত মাটিতে পড়ে। কিন্তু হেলানো তলে বস্তু গড়িয়ে গ্যালিলেও প্রমাণ করেছিলেন যে মুক্তভাবে পতনশীল বস্তুর ত্বরণ ভর-নিরপেক্ষ। এই ত্বরণই অভিকর্ষজ ত্বরণ। চিন্তা সর্ঠিক কিনা তা যাচাই করে দেখার প্রয়োজনীয়তা দার্শনিক উপলব্ধি করেন নি, কিন্তু বিজ্ঞানী করেছিলেন। সেই থেকেই বিজ্ঞানের পথ দর্শনের থেকে আলাদা।
তাহলে বাস্তবতার স্বরূপ সম্বন্ধে বিজ্ঞান কী বলছে ? প্লেটো থেকে শুরু করে সবাই বাস্তবতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। প্লেটোর জগৎ ছিল ভাবনার জগৎ। তিনি মনে করতেন আমরা যা কিছু দেখি-শুনি-ঘ্রাণ নেই-স্পর্শ করি-স্বাদ নেই অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল বস্তুর এক আদি অকৃত্রিম আদর্শ রূপ আছে। তার সাথে তুলনা করেই আমরা বাস্তবতা সর্ম্পকে আমাদের ধারণা গড়ি। একটা গোলাপ কত সুন্দর সেটা সেই ভাবনার জগতের আদর্শ গোলাপের সাথে আমাদের অবচেতন তুলনা করে। এভাবে আমরা বাস্তবতা সর্ম্পকে ধারণা পাই। সকল দৃশ্য ও অদৃশ্য বস্তুর আদর্শ প্রতিরূপ কোথাও-না-কোথাও সত্যিই বিরাজমান এবং বাস্তবতার এই ধারণাকে ‘প্লেটোনিক রিয়ালিটি’ বলে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় দার্শনিকদের মধ্যে রেনে দেকার্তে বলেছিলেন ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’ এও বাস্তবতার এক স্বরূপ। কিন্তু বিজ্ঞানে বাস্তবতা সেটাই যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ দাবী করে। বাস্তবতার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিমূর্ত যুক্তির সাহায্যে গাণিতিক মডেল তৈরি করেন। তারপর সেই মডেল বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে কি-না, তা যাচাই করেন। তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী যদি পরীক্ষায় মেলে তো পাশ, নয়তো নতুন মডেলের সন্ধান করতে হবে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বাইরে কোনো বাস্তবতা আছে কি-না তা বিচার্য নয়, প্রাকৃতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তত্ত্ব বা মডেল যা বা যতটুকু বলতে পারে সেটাই বাস্তব। এই কাজে বিজ্ঞানীর সহায়ক হলো পঞ্চেন্দ্রিয় ও কান্ডজ্ঞান যা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চালাতে সাহায্য করে, এবং গাণিতিক যুক্তির সাহায্যে তৈরি করা সূত্র যা গণনা করে বলে দিতে পারে অমুক জায়গায় অমুক জিনিস অমুকভাবে পাওয়া যাবে। এইগুলোই হলো বিজ্ঞানীর হাতিয়ার বা ‘টুল’। একেই বলে বাস্তবতার মডেল-ভিত্তিক ব্যাখ্যা। বাস্তবতার এই ব্যাখ্যা অনেক বিজ্ঞানীর কাছেই পছন্দের নয়। অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন যে তত্ত্ব-নিরপেক্ষ এক চিরকালীন বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু হকিং বলছেন যে এই প্লেটোনিক বাস্তবতার কোনো মানে নেই এবং এই অলীক ধারণা ত্যাগ করার সময় এসেছে।
আমরা কীভাবে বুঝব যে আমাদের তত্ত্ব বা মডেল সঠিক কি-না ? অর্থাৎ একটা ভালো মডেলের কী কী গুণাগুণ থাকা উচিত ? একটা মডেল তখনই ভালো মডেল হবে যদি এটি ১) সুচারু ও সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়, ২) যদৃচ্ছ প্যারামিটারের সংখ্যা কম হয়, ৩) সকল (কিংবা নিদেনপক্ষে অধিকাংশ) পর্যবেক্ষণের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম, এবং ৪) তত্ত্বটির ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ভালো হতে হবে, অর্থাৎ মডেলটি এমনসব ভৌতঘটনার কথা বলবে যা পর্যবেক্ষণ করে বলা সম্ভব মডেলটি ঠিকঠাক আছে কি-না। এই নিরিখে প্রাচীন ঋষিদের ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমের সমন্বয়ে গঠিত জগৎ-মডেল কোনোমতেই ভালো মডেল নয়। এভাবে যাচাই-বাছাই করে যেসব মডেল টিকে যায় তারা বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের যা বলতে পারে, সেটাই বাস্তবতার আপাত স্বরূপ বলে গণ্য হবে। এটাই হকিংয়ের কথা।
এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করা যায়। কয়েক বছর আগে ইতালির এক ছোট শহরের পৌরসভা তাদের নাগরিকদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, যাদের বাসায় অ্যাকুইরিয়াম আছে তারা যেন গোল স্বচ্ছ বাটিতে গোল্ডফিশ না রাখেন। তাতে করে গোল্ডফিশের মনে বাস্তবতা সম্পর্কে একটা বিকৃত ধারণা জন্মায়। কারণ গোলাকার বাটি থেকে বহির্বিশ্বের এক অঋজু প্রতিবিম্ব পাওয়া যায় যা প্রকৃত বাস্তবসম্মত নয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি গোল্ডফিশের থেকে ভালো বা স্পষ্ট কিছু দেখি ? আমরাও কি বহিবির্শ্ব সম্পর্কে ধারণার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের উপর নির্ভরশীল নই ? তাহলে গোল্ডফিশে আর আমাতে পার্থক্য কোথায়।
আমরাও কিন্তু প্রকৃতি সম্পর্কে একটা অবচেতন মডেল তৈরি করি। প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় যে সব সংকেত পায়, আমাদের মস্তিষ্ক সেই সংকেত নিয়ে বহিবির্শ্ব সম্পর্কে আমাদের একটা মডেল দেখায়। এটাই আমাদের মানসিক চিত্র। যেমন দৃষ্টিশক্তির কথা যদি বিবেচনা করি। আমাদের দু’চোখের রেটিনায় যে ছবি ধরা পড়ে সেই দ্বিমাত্রিক ফ্রেম অপটিক নার্ভ বেয়ে আমাদের মস্তিষ্কে যায়। অপটিক নার্ভের পেছনে যদি একটা ক্যামেরা রাখা যেত তাহলে আমরা দেখতে পেতাম চোখের রেটিনা দৃশ্যপটের কেমন ছবি তুলছে। রেটিনা যে ছবি মস্তিষ্কে পাঠায় তা খুবই খারাপ, তার অনেক পিক্সেলই কালো। মোট কথা, রেটিনা একটা টুটাফাটা ছবিই মস্তিষ্কে পাঠায়। মস্তিষ্কের ইমেজ প্রসেসিং এতো উন্নতমানের যে ঐ টুটাফাটা দ্বিমাত্রিক ছবি থেকে তা একটা রঙিন সুন্দর ত্রিমাত্রিক ছবি আমাদের উপহার দেয়। এভাবে মস্তিষ্ক বহির্বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের মানসিক চিত্র বা মেন্টাল ইমেজ তৈরি করতে সাহায্য করে। কাজেই এক অর্থে বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝি তা আমাদের মস্তিষ্কেই তৈরি হচ্ছে। কাজেই বাস্তবতার এক ঐশী মডেল আছে এই ভাবনাটা, মনে হয়, ত্যাগ করাই ভালো।
এই তত্ত্ব-নির্ভর বাস্তবতার মূলে রয়েছে আমাদের সুন্দর তত্ত্বসমূহ। তাহলে প্রশ্ন জাগে, যে মডেলগুচ্ছ প্রকৃতির বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের আভাস দেয় সেই তত্ত্ব বা তথাকথিত মডেলগুলো কী ? এই তত্ত্বগুলো আছে বলেই আমরা প্রকৃতির ক্রিয়াকর্ম বুঝতে পারি, তাকে কাজে লাগিয়ে লাগসই প্রযুক্তি বানাতে পারি এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিকাশ ঘটাতে পারি। কার্যকর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না থাকলে আজকের এই ‘ডিজিটাল সভ্যতা’ থাকতই না। আইনস্টাইন বলেছিলেন ‘বিশ্বকে যে কেন বোঝা যায় সেটাই বোধগম্য নয়।’ আর হকিং জবাবে বলেছেন, ‘বিশ্বকে বোঝা যায় তার কারণ বিশ্ব বৈজ্ঞানিক রীতিনীতি মেনে চলে, অর্থাৎ বিশ্বের আচরণকে মডেল করা সম্ভব।’ এইরকম মডেলগুচ্ছের প্রথমটি হলো ১৬৮৭ সালে প্রদত্ত নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। এই মহাকর্ষ শক্তির ফলে গাছের আম মাটিতে পড়ে এবং গ্রহ-নক্ষত্র যার যার নিজস্ব কক্ষপথে অধিষ্ঠিত থাকে। কাছে-দূরের ভর-বিশিষ্ট সকল বস্তুই মাধ্যাকর্ষণের আওতায় পড়ে, তাই এই আইনের নাম বিশ্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র। দ্বিতীয় যে মডেলটি আমরা পাই তা হলো বৈদ্যুতিক ও চুম্বকীয় ধর্মাবলি সম্পর্কে আমাদের মডেল। এই মডেল একাধিক বিজ্ঞানীর হাতে পরিপক্কতা পেয়েছে। বিশেষ করে, মাইকেল ফ্যারাডে প্রচুর সংখ্যক পর্যবেক্ষণ করে পদার্থের বৈদ্যুতিক ধর্ম ও চুম্বকের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করেন। চৌম্বক বলরেখার আবিষ্কার ফ্যারাডের অমর কীর্তি। বিজ্ঞানীদের এমন কিছু কীর্তি থাকে যেগুলো অসাধারণ, যেখানে চিন্তা ও কল্পনার অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে, যেগুলো যুগান্তকারী। ফ্যারাডের পর্যবেক্ষণগুলো মামুলি না হলেও যুগান্তকারী আবিষ্কার নয়। ফ্যারাডে যদি না করতেন, তবে অন্য কেউ পরবর্তীকালে ঠিকই এসব খুঁজে পেতেন। কিন্তু বলরেখার মতো একটা সম্পূর্ণ বিমূর্ত কনসেপ্ট দাঁড় করানো ফ্যারাডে ছাড়া হয়ত সম্ভব হত না। এজন্যই তিনি যুগান্তকারী। যেমন অনেকেই বলেন আইনস্টাইন না হলেও অন্য কেউ (যেমন লোরেন্স বা পঁয়কারে) আপেক্ষিকতার বিশেষ সূত্রাবলি আবিষ্কার করলেও করতে পারতেন। কারণ মাইকেলসন-মর্লির বিখ্যাত পরীক্ষার সাহায্যে আলোর দ্রুতির ধ্রুবত্ব প্রতিষ্ঠা স্থানাংকের আপেক্ষিকতার ধারণাকে খুব জোরালো একটা ভিত্তি দেয়। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব এক অসাধারণ কবিতা ! তাই আইনস্টাইন যুগান্তকারী।
যাহোক ১৮৬০’র দশকে আরেক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটান জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তিনি চারটি অনবদ্য সমীকরণ প্রস্তাব করেন যা বস্তুর চুম্বকত্ব ও বৈদ্যুতিক ধর্মাবলিকে একই বিদ্যুৎ-চুম্বক বলের ভিন্ন বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ম্যাক্সওয়েলের এই চারটি সমীকরণ একইসাথে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বিকিরণ, সম্পুর্ণ ইলেকট্রিকাল এঞ্জিনিয়ারিং, বিদ্যুৎ-শক্তি, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ব্যাখ্যা করে। প্রকৃতির বলসমূহের একীভবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ম্যাক্সওয়েল প্রথম মাইলফলকটি রচনা করেন। এরপর আমরা পাই আইনস্টাইনের মহাকর্ষ আইনের সাধারণ তত্ত্ব যেখানে তিনি বস্তুর ভরকে স্থান-কালের বক্রতার সাথে সম্পর্কিত করেন। এই দুটি প্রধান বল ছাড়াও প্রকৃতিতে আরো দুটি মৌলিক বল আছে যারা পরমাণুর অন্দরমহলে কাজ করে। কারণ, এদের পাল্লা বড়ই ক্ষুদ্র। এরা হলো সবল নিউক্লিয় বল (যা পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠনে সাহায্য করে) এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল (যা তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী)। পরমাণুর অভ্যন্তরে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সবল নিউক্লিয় বল, তারপর বিদ্যুৎ-চুম্বক বল, তারপর দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং সবচেয়ে ক্ষীণ হলো মহাকর্ষ শক্তি। বৃহৎ স্কেলে এই মহাকর্ষই মহাবিশ্বকে বর্তমান চেহারা দিয়েছে, কিন্তু পরমাণুর খপ্পরে সে অতীব ক্ষীণ।
বিজ্ঞানীদের এই এক তুরীয় ধারণা যে, প্রকৃতির সকল বল আসলে একটি একক মূল-বলের বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ একটা মূল-বল আছে যা ভিন্ন ভিন্ন ভৌত শর্তের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নেবে। এই ভাবনাটিকে অনেকেই প্লেটোনিক রিয়ালিজমের অনুরূপ ভাবেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ ১৯৬০’র দশকে আব্দুস সালাম, স্টিভেন ওয়েইনবার্গ ও শেলডন গ্ল্যাশো দেখিয়েছেন যে বিদ্যুৎ-চুম্বক বল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল আসলে একই বলের দুটি ভিন্ন রূপ। এরপর বিজ্ঞানীরা এমন এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন যাতে করে সবল নিউকিøয় বলকেও অপর দুটি একীভূত বলের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়। এই তত্ত্বের নাম ‘গাট’ বা গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি অথবা অনেকে একে স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে। এই মডেলেরই প্রমাণ খুঁজছে জেনেভার লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। সুতরাং বিজ্ঞানীদের দোষী করা যায় না, যদি তাঁরা ভাবতে চান যে আসলেই প্রকৃতির সকল বল একটি একক বলের বহিঃপ্রকাশ। এবং আমাদের সকল কার্যকর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা মডেলের মূলে আছে এক চূড়ান্ত তত্ত্ব বা মডেল যাকে বলে ‘সবকিছুর তত্ত্ব’। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন এই থিওরি অব এভ্রিথিংই হবে আমাদের সেই স্বপ্নের সোনার হরিণ। এর সাহায্যে আমরা প্রকৃতির সকল প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা পাবো। প্রকৃতি বড়ই সৌন্দর্যপ্রিয় এবং সে অঙ্কের ভাষা খুব ভালো বোঝে। প্রকৃতির সবকিছুতেই একটা অতুলনীয় প্রতিসাম্য কাজ করে, তাই প্রকৃতি বাহুল্য পছন্দ করে না। কাজেই বিজ্ঞানীরা যদি ভাবতে ভালো বাসেন যে আসলে একাধিক মডেল নয়, মূল মডেল একটিই একাধিক বল নয়, প্রাচীন আদ্যাবল একটিই, তো আপনি কি একে অযৌক্তিক বলবেন?
কিন্তু সমস্যা হলো, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কিছুতেই মহাকর্ষকে ঢোকানো যাচ্ছে না। বেয়াড়া গরুর মতো সে কেবলই এদিক-ওদিক ঢুসঢাস দিচ্ছে। কিছুতেই গোয়ালে ঢুকছে না, তাই বেচারা গেরস্তও দরজাটি লাগিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরতে পারছে না। দেখা যায়, অন্য তিনটি বলের সার্থক ও কার্যকর কোয়ান্টাম তত্ত্ব থাকলেও কোয়ান্টাম মহাকর্ষের কোনো তত্ত্বই কার্যকর করা যাচ্ছে না। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে কিছুতেই বাগ মানিয়ে পরমাণুর ভেতরে ঠেলে দেওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুর তত্ত্বের অধীনে সকল বলের একীভবনের এই স্বপ্নের সোনার হরিণের পেছনে আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন। নাহ, স্বপ্নের হরিণ তাঁকে ধরা দেয়নি ‘সে যে নাগাল পেলে, পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁধা’।
স্ট্যান্ডার্ড মডেল আমাদের কী বাস্তবতা উপহার দেয়? বাটির মধ্যে থেকেও কি বুদ্ধিমান গোল্ডফিশের পক্ষে স্ট্যান্ডার্ড মডেল পাওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল প্রকৃতি সম্পর্কে শৃঙ্খলাবদ্ধ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে গোল্ডফিশের পক্ষেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব। বাস্তবিকই আমাদের নিজেদের সাথে গোল্ডফিশের খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরাও বিশ্বকে দেখি একটি সাধারণ তারার একটি ক্ষুদ্র গ্রহ থেকে এবং সৌরজগতের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বাইরের দিকে। কাজেই গোলবাটির মধ্যে থেকে পৃথিবীকে গোল্ডফিশ যেভাবে পর্যবেক্ষণ করে, আমরাও ঠিক একইভাবে বিশ্বজগৎকে দেখি।
কিন্তু আমাদের অবস্থানই বা মহাবিশ্বে কতখানি প্রান্তিক ? বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে আমাদের পৃথিবীর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে যাতে করে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। সূর্য একটা মাঝারি মানের নক্ষত্র যার জীবনকাল প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর এবং এই দীর্ঘ জীবনকালের একটা বড় সময় সূর্য খুব সুস্থির থাকে। সূর্যের মাঝে যদি চাঞ্চল্য জাগত, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রাও ভীষণভাবে ওঠানামা করত। প্রাণ সৃষ্টির জন্য সেটা মোটেই উপযুক্ত হতো না। প্রাণ সৃষ্টির জন্য চাই একটা খুব তুলতুলে পরিবেশের। যেমন পৃথিবী সূর্য থেকে যে দূরত্বে অবস্থিত সেই দূরত্বে পৃথিবীতে যে তাপমাত্রার সৃষ্টি হয় তাতে পানির মতো একটা বিশ্বজনীন জৈব দ্রাবককে কঠিন-তরল-বায়বীয় এই তিন দশাতেই পাওয়া যায়। তুলনায় শুক্রগ্রহ বা মঙ্গলের বৈরী পরিবেশ চিন্তা করা যায়। শুক্র সূর্যের খুব বেশি কাছে, ফলে সেখানে টেকটোনিক অ্যাকটিভিটি বেশি, তাই গ্রিনহাউজ গ্যাসও বেশি জমা হয়েছে বাতাবরণে। ফলে সেখানকার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪৫০ সেন্টিগ্রেড যেটা প্রাণ-বান্ধব নয়। অন্যদিকে, মঙ্গল এতো দূরে যে সেখানে পানি হয় জমাটবদ্ধ বরফ নয়তো ভূ-গর্ভের অভ্যন্তরে প্রবহমান। এই দুই পরিবেশ অণুজীবের পক্ষে সহায় হলেও মানুষের মতো বহুকোষী উন্নত প্রাণীর উন্নত সভ্যতার জন্য উপযুক্ত নয়। ছায়াপথের অন্যান্য নক্ষত্রে গ্রহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও যদি গ্রহগুলো ‘বাসযোগ্য পরিবেশে’ থাকে তবেই সেখানে প্রাণ সৃষ্টি হবে এবং বিবর্তনের ধারায় উন্নত প্রাণীর উদ্ভব হবে। কিন্তু প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক এই পরিবেশের উপস্থিতি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়, কোনো পারিবেশিক সমাপতনও নয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, আমাদের বিশ্বের ভৌত বিধিগুলোও এমন যে তা প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক। যেমন, সকল নিউক্লিয় বল যদি আরো শক্তিশালী হতো বা দুর্বল হতো, তাহলে হয় হাইড্রোজেনের থেকে ভারী আর কোনো মৌল সৃষ্টি হতে পারত না নতুবা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়াই অসম্ভব হতো (ফলে কোনো নক্ষত্র কোনোদিন জ্বলে উঠত না)। মহাকর্ষ বল যদি আরেকটু জোরালো হত, তাহলে সৌরজগৎ আরো ছোট পরিসরের হতো এবং সেক্ষেত্রে স্থায়ী কক্ষপথের অস্তিত্ব থাকত না, গ্রহে-গ্রহে সংঘর্ষের হার বেড়ে যেত। যদি মহাকর্ষ আরেকটু দুর্বল হতো তাহলে কক্ষপথগুলো আরো দূরে দূরে থাকত, গ্রহগুলোর তাপমাত্রা খুবই কম হতো এবং গ্রহগুলোর কক্ষপথ ত্যাগের সম্ভাবনা বেশি হতো। তাছাড়া নক্ষত্রের ভেতরকার বিকিরণ ও মহাকর্ষের চাপের সুস্থিতিও গড়বড় হয়ে যেতো, এবং এতে করে নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল কমে যেত। আমরা কার্বন-ভিত্তিক প্রাণী। এই কার্বনের অস্তিত্বই থাকত না যদি সবল নিউক্লিয় বলের শক্তি ০.৫% এদিক-ওদিক হতো কিংবা বৈদ্যুতিক শক্তি ৪% কম-বেশি হতো। শুধু চারটি বলের শক্তি-প্রাবল্যের হেরফেরই নয়, দেখা যায় মহাবিশ্বের অন্য প্যারামিটারগুলোর (যেমন ইলেকট্রনের চার্জ, প্রোটনের ভর, আলোর দ্রুতি) মান যদি কিছুটা অন্যরকম হতো, তবে বুদ্ধিমান প্রাণী এই বিশ্বের কোথাওই সৃষ্টি হতে পারত না। এভাবে বৈজ্ঞানিক মডেল ব্যবহার করে যদি কৃত্রিম বিশ্ব-পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যায় এবং সেখান থেকে জানা যায় যদি মৌলিক বলসমূহ অন্যরকম হতো বা ধ্রুবরাশিগুলির মান একটু এদিক-ওদিনক হতো, তবে বিশ্ব কেমন হতো। তাই হকিং বলেন, ‘প্রকৃতির ভৌত বিধিসমূহ এমন এক সিস্টেম উপহার দিয়েছে যা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সমন্বিত বা ফাইন-টিউন্ড্। এই ভৌত বিধিগুলির সামান্য পরিবর্তন ঘটালেই আমাদের অতি পরিচিত এই জীবনের অস্তিত্বই নস্যাৎ হয়ে যায়। কাজেই ভৌতবিধিসমূহে একাদিক্রমে যদি এইসব কাকতালীয় সমাপতন না থাকত, তবে মানুষ এবং এইরকম অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব কোনোদিনই সম্ভব হতো না।’ এই ধরনের বিশ্বকে তাই বলে ‘গোল্ডিলক্সের বিশ্ব’।
ভিক্টোরিয় যুগের এক সুপরিচিত গল্পে গোল্ডিলক্স নামের এক কিশোরী বনের মধ্যে পথ হারিয়ে এক ভালুক-দম্পতির বাসা খুঁজে পায়। সেখানে সবকিছুই তিন রকমের বাবা-ভালুকের জন্য খাবারটা খুব গরম, বিছানাটা খুব শক্ত, চেয়ারটা খুব কঠিন, মা-ভালুকের জন্য খাবারটা খুব ঠান্ডা, বিছানাটা খুব নরম, চেয়ারটা খুব নরম। কিন্তু বাচ্চা-ভালুকের খাবারটা না-গরম-না-ঠান্ডা, বিছানাটা না-নরম-না-শক্ত, চেয়ারটা অতিশয় আরামপ্রদ। অর্থাৎ বাচ্চা-ভালুকের জিনিসগুলো একদম ঠিক। গোল্ডিলক্সের সেটাই পছন্দ। আমাদের বিশ্বও এরকম ঠিক গোল্ডিলক্সের মতো ‘জাস্ট রাইট’। এই সমাপতন খুব স্বাভাবিকভাবেই অতীন্দ্রিয় ভাবুকদের তুরীয় ভাবনাকে উৎসাহিত করে।
কিন্তু গোল্ডিলক্সের বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? বিজ্ঞান তো তুরীয় ভাবনায় চলে না। এখানেই হকিং তাঁর ‘ওস্তাদের মার’ মেরেছেন এই বইতে। তিনি বলেছেন স্ট্রিং থিওরির এক সম্প্রসারণ যার নাম ‘এম থিওরি’ এই এম-থিওরিই দিতে পারে এই সমস্যার সমাধান। এই ‘এম’ শব্দের অর্থ কী তা কেউ জানে না হতে পারে এটা ‘মাদার’ বা ‘মিরাকেল’ বা অন্যকিছু। এম-থিওরি পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্ট্রিং থিওরির একত্র সমাবেশ। প্রতিটি তত্ত্বই একটি নির্দিষ্ট পরিসরের ভৌত ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করে, কিন্তু সবগুলোকে নয়। এভাবে বাস্তবতার একটা পরস্পর-বিযুক্ত চিত্র পাওয়া যায়। হকিং বলছেন যে একটিমাত্র তত্ত্বে বা একসেট সুচারু-সমীকরণ সমস্ত বিশ্বকে ব্যাখ্যা করবে এই প্লেটোনিক ভাবনা বাদ দিয়ে আমাদের উচিত হবে এম-থিওরি’র মডেল-নির্ভর বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। এই বাস্তবতা অনন্য বাস্তবতা নয়। জগতের স্বরূপ নির্ভর করে কী মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা হচ্ছে তার উপর।
এই এম-থিওরিই আমদের ‘সবকিছুর তত্ত্ব’। একইসাথে এই এম-থিওরি বহুসংখ্যক মহাবিশ্বের কথা বলে। এই অনুসিদ্ধান্তের নাম মাল্টিভার্স থিওরি। এই থিওরি বলে আমাদের বিশ্ব ছাড়াও আরও প্রায় ১০^৫০০ বিশ্ব আছে যাদের ভৌত বিধিমালা ও ধ্রুবরাশিগুলি আলাদা। এদের মাত্র গুটিকয়েক নমুনা-বিশ্বেই প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব যাদের নিয়মকানুন প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক। ঠিক সে কারণেই ঐরকম এক বিশ্বে আমাদের উদ্ভব হয়েছে, আর কিছু নয়। উক্ত এম-থিওরিতে দেশকালের মাত্রা এগারো চারটি ভিন্ন বাকি সব মাত্রা অত্যন্ত ক্ষুদ্রস্কেলে প্রকাশ পায়। এটাই ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইনে’ হকিংয়ের কহতব্য বিষয়। হকিংয়ের জবানিতে শুনুন:“কয়েকশ’ বছর পূর্বে নিউটন দেখিয়েছিলেন যে গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে পৃথিবীতে ও ব্যোমে, বস্তুর মিথস্ক্রিয়ার সুন্দর ও সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন যে তাহলে সঠিক তত্ত্বটি যদি জানা থাকে এবং যদি বিশাল গণনা করার জন্য উপযুক্ত ক্ষমতা থাকে, তবে পুরো মহাবিশ্বের ভূত-ভবিষ্যৎ আমরা জেনে ফেলতে পারব। তারপর এলো কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা, বক্র স্থান, কোয়ার্ক, স্ট্রিং ও তৎসংলগ্ন (দেশকালের) অতিরিক্ত মাত্রা এবং এদের সম্মিলনে পাওয়া যায় ১০^৫০০ বিশ্ব যাদের প্রতিটির নিয়মকানুন একে অপর থেকে আলাদা, এবং যাদের কেবল একটিই হলো আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ। কিছু সাধারণ সহজ অনুমিতির উপর নির্ভর করে গড়ে তোলা যায় এমন একটি একক তত্তে¦র অস্তিত্ব থাকবে যা আমাদের এই জগতের সকল আপাত নিয়মকানুনকে ব্যাখ্যা করবে পদার্থবিদদের এই চিরকালীন স্বপ্নকে এখন বোধ হয় বাদ দেওয়াই ভালো।”
তার বদলে, হকিং বলছেন, এম-থিওরি-ভিত্তিক বাস্তবতাই মেনে নেওয়া শ্রেয়, যদিও এম-থিওরির এখনো পর্যবেক্ষণসম্মত প্রমাণ মেলেনি। এম-থিওরির প্রতি হকিংয়ের সমর্থনের কারণ এটি বিশ্বের ‘আপাত অলৌকিক’ সমাপতনকে ব্যাখ্যা করে, এটি বাস্তবতার একটি ব্যাখ্যা দেয়, সর্বোপরি এটি মহাকর্ষ-জাতীয় বলকে অন্য বলগুলোর সাথেও একীভূত করে। মহাকর্ষ-জাতীয় বলের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, কারণ এই বলই পারে শূন্য থেকে বিশ্বকে সৃষ্টি করতে। ১৯৮৮ সালে হকিং তাঁর ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ এ বলেছিলেন যে সবকিছুর তত্ত্ব পেলে আমরা ‘ঈশ্বরের মন’ বুঝতে পারব। এখন তিনি বলছেন যে এম-থিওরি যদি শেষতক পাশ করে তবে সেটাই হবে ‘সবকিছুর তত্ত্ব’ এবং ‘তাহলে আমরা বলতে পারব যে আমরা বিশ্বের মূল নকশাটি খুঁজে পেয়েছি’। এই মূল নকশার খোঁজই হকিং ও ম্লোদিনো’র ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
তাহলে গোলবাটিতে থাকা গোল্ডফিশের সাথে আমাদের খুবই মিল বলা যায়। গোলবাটির পানিতে থেকেও বুদ্ধিমান গোল্ডফিশ এই জগতের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। আমরাও বিশ্বের এক সাধারণ গ্যালাক্সির ততোধিক সাধারণ গ্রহের বাসিন্দা হয়েও কেবল বিমূর্ত যুক্তির নিরিখে ১০^৫০০ সংখ্যক বিশ্ব সম্পর্কে এমনকি চিন্তা করতেও পারছি। এটাই আমাদের সার্থকতা এবং অবশ্য সেটা গোল্ডফিশেরও সার্থকতা। কারণ, গোলবাটির পরিবর্তে সাধারণ পাত্রে রাখলে তার পক্ষে জগতের ব্যাখ্যা সহজ হবে এজন্য যে বাটির গোলকত্বের কারণে সৃষ্ট প্রতিফলন-প্রতিসরণের অতিরিক্ত ঝামেলা থেকে সে মুক্ত।
এইবার আসা যাক মিডিয়ার খবরে। হকিং ও ম্লোদিনো’র ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকেই মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই পত্রিকার প্রথম পাতায় বইটি সংবাদ হয়েছে। অবশ্য খ্যাতি স্টিফেন হকিংয়ের কাছে নতুন বিষয় নয়। কিন্তু এবারেরটি একটু আলাদা। কারণ, এবারে হকিংয়ের প্রতিপক্ষ স্বয়ং ঈশ্বর। যেমন, টাইম্স পত্রিকার শিরোনাম “হকিং : গড ডিড নট ক্রিয়েট ইউনিভার্স।” তাছাড়া আর্চবিশপ থেকে শুরু করে নানা বয়েসী মানুষ বুঝে-না-বুঝে পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগ, অন্তর্জালের সামাজিক ওয়েবসাইটগুলো (ফেসবুক, টুইটার), ব্লগে-ব্লগে কমেন্টে সয়লাব করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিভিশনের টক-শো’র কথা তো বাদই দিলাম। সব জায়গায় একই কথা, হকিং ঘোষণা দিয়েছেন ঈশ্বর নেই। হকিং এবং ম্লোদিনো তাঁদের পুরো বইয়ে কোথাওই বলেননি যে ঈশ্বর নেই। একজন বিজ্ঞানী যেভাবে ভৌত প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা খোঁজেন, ঠিক সেভাবেই ওঁরা এই বইয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়াস পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক গল্প বলা যায়। লাপ্লাস যখন তাঁর বিখ্যাত নভোমন্ডল বিষয়ক গ্রন্থটি নেপোলিয়নের হাতে দিলেন, তখন সম্রাট ওঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, এতে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে কি ? জবাবে লাপ্লাস বলেছিলেন, মান্যবর, ঐ অনুমানের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। এটাই বিজ্ঞানের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। ঠিক এই ঐতিহ্যই হকিং তাঁর বইতে বজায় রেখেছেন। কোনো ঐশী প্রভাবের বাইরে থেকে এই জগতের ব্যাখ্যা অনুসন্ধানই বিজ্ঞানের রীতি। কিন্তু মিডিয়া বৃথাই প্রচারের পারদ চড়িয়েছে। সিএনএন’এর ল্যারি কিং’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছেন যে, হ্যাঁ, ঈশ্বর থাকতে পারেন, কিন্তু শুধু বিজ্ঞান দিয়েও মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এটাই বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য।
আর দার্শনিকরা বেজায় খেপেছেন দর্শনকে ‘মৃত’ বলায়। এমনকি তাঁর বইকে ‘দার্শনিক ছেলেমানুষী’ বলে অনেকে গাল পেড়েছেন, কেউ হকিংকে ‘দিব্যজ্ঞানী’ বলেও ব্যঙ্গ করেছেন। আর বিজ্ঞানীরা ? অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এই বইটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ফিজিক্সের অধ্যাপক জেম্স ট্রেফিল ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ লিখেছেন,‘এই বইটি কোনো সমীকরণ ছাড়াই আধুনিক কসমোলজির গভীরতম প্রশ্নগুলোর আলোচনায় নিয়ে যায়।’ স্ট্যানফোর্ডের বিখ্যাত পদার্থবিদ লিওনার্ড সাসকিন্দ বলেছিলেন যে সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজ এখনই শেষ হয়ে যায়নি। তাছাড়া স্ট্রিং থিওরির সমালোচকরা তো আছেনই। বলা বাহুল্য, স্ট্রিং থিওরি সকলের পছন্দ নয়। এ নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এমনকি একটি বইও বেরিয়েছে যার নাম ‘নট ইভেন রং’। অর্থাৎ স্ট্রিং থিওরি ঠিকও না, ভুলও না। তাহলে এটা কী ? ঠিক না এ কারণে যে এর কোনো পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণ হাজির করা যায়নি, ভুল নয় এ কারণে যে এর গাণিতিক ফ্রেমওয়ার্কে কোনো ফাঁক নেই। তাই এম-থিওরির সমর্থক এখনো সবাই হয়ে ওঠেননি। তবে একটা ব্যাপার দৃষ্টি কেড়েছে, স্ট্রিং থিওরির সমালোচনা সত্ত্বেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসরশিপের পদটি হকিংয়ের পর মাইকেল গ্রিনকে দেওয়া হয়েছে যিনি প্রথম দিককার একজন স্ট্রিং থিওরিস্ট।
এই বইয়ে হকিং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে বিশ্বের একটা ডিজাইন আছে, কিন্তু এই ডিজাইনের উৎপত্তি হয়েছে আরো অনেক অগুণতি বিশ্বের সাথে এবং এই নকশা এম-থিওরির গণিত থেকেই আসে। কিন্তু এই এম-থিওরির অস্তিত্ব, অনেকটা ঈশ্বরের মতোন, সুপ্রমাণিত নয় । তাহলে কৌতুকচ্ছলে কি বলা যায় না যে, বিশ্বের মূল কথা সেই একই ‘থোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়’!সুত্র: http://sonarbangladesh.com