Archive for 2012

‘লাইলাতুল কদর’ মহিমান্বিত ও শ্রেষ্ঠ রজনী


‘লাইলাতুল কদর’ আরবি শব্দ। এর অর্থ অতিশয় সম্মানিত ও মহিমান্বিত রাত বা পবিত্র রজনী। আরবি ভাষায় ‘লাইলাতুন’ অর্থ হলো রাত্রি বা রজনী এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান, মর্যাদা। এ ছাড়া এর অন্য অর্থ হলো—ভাগ্য, পরিমাণ ও তাকদির নির্ধারণ করা। এ রাত্রিকে লাইলাতুল কদর হিসেবে নামকরণ করার কারণ হলো, এ রজনীর মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদীর সম্মান বৃদ্ধি করা হয়েছে বা এ রাতে মানবজাতির তাকদির পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তাই এই রজনী অত্যন্ত পুণ্যময় ও মহাসম্মানিত। আল্লাহ তাআলা যে মহিমাময় রাত্রিকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন, যে একটি মাত্র রজনীর ইবাদত-বন্দেগিতে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও অধিক সওয়াব অর্জিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, উম্মতে মুহাম্মদীর পরম সৌভাগ্য যে কালপরিক্রমার ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর মাহে রমজানে সেই মহিমান্বিত ও শ্রেষ্ঠ রজনী লাইলাতুল কদর পুনরায় কল্যাণ, শান্তি ও মুক্তির সওগাত নিয়ে মুসলমানদের জীবনে ফিরে আসে। 
লাইলাতুল কদর এমন মহিমান্বিত বরকতময় এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ জন্য যে, এ রাতের শ্রেষ্ঠত্ব মাহাত্ম্য ও মর্যাদার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—এ গৌরবময় রজনীতে মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মুক্তির সনদ মহাপবিত্র ঐশী গ্রন্থ ‘আল-কোরআন’ অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে তুমি কি জানো? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফেরেশতারা ও রুহ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে উষার আবির্ভাব পর্যন্ত।’ (সূরা আল-কদর, আয়াত ১-৫) 
লাইলাতুল কদরের যাবতীয় কাজের ইঙ্গিত দিয়ে এ রজনীর অপার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে অন্যত্র ইরশাদ করেছেন, ‘হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।’ (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪) কদরের রাতে অজস্র ধারায় আল্লাহর খাস রহমত বর্ষিত হয়। এ রাতে ফেরেশতারা ও তাঁদের নেতা হজরত জিবরাঈল (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করে ইবাদতরত সব মানুষের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকেন। এ রজনীতে এত অধিক সংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন যে সকাল না হওয়া পর্যন্ত এক অনন্য শান্তি বিরাজ করতে থাকে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’ (মাযহারি) 
লাইলাতুল কদরে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদেরকে লিখে দেওয়া হয়, এমনকি এ বছর কে হজ করবে, তা-ও লিখে দেওয়া হয়। 
লাইলাতুল কদরের ফজিলত অপরিসীম। হাজার মাস ইবাদতে যে সওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদত তার চেয়ে উত্তম। লাইলাতুল কদরের মহিমাময় রাতে মুমিন মুসলমানদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয়। লাইলাতুল কদরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ লাভ করা যায়। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তাঁর পূর্বেকৃত সব গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন।’ (বুখারি) 
লাইলাতুল কদরের রজনীতে যে বা যারা আল্লাহর আরাধনায় মুহ্যমান থাকবে, মহান স্রষ্টা তাঁর ওপর থেকে দোজখের আগুন হারাম করে দেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সমস্ত রজনী আল্লাহ তাআলা লাইলাতুল কদর দ্বারাই সৌন্দর্য ও মোহনীয় করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা এ বরকতময় রজনীতে বেশি বেশি তাসবিহ-তাহলিল ও ইবাদত-বন্দেগিতে রত থাকো।’ অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের কবরকে আলোকিত পেতে চাইলে মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর রাতে জেগে রাতব্যাপী ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দাও।’ সুতরাং আল্লাহর অশেষ রহমতে আবৃত এ রাত যাতে বৃথা না যায়, সে জন্য রাতব্যাপী ইবাদত-বন্দেগি, তাসবিহ-তাহলিল এবং অন্তরের আকুতিভরা প্রার্থনার মাধ্যমে রাহমানুর রাহিমের অসীম করুণা ও ক্ষমা ভিক্ষা করা বান্দার জন্য খুবই জরুরি।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবে কদর সন্ধান করো।’ (বুখারি ও মুসলিম) 
আরেকটি হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর সন্ধান করো।’ (বুখারি) 
সুতরাং কিয়াম করা, ইবাদত বা সাধনা করা দ্বারা এ রাতে তারাবি-তাহাজ্জুদসহ অধিক নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর জিকির, একাগ্রচিত্তে দোয়া এবং অতীত পাপমোচনে বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য পরিবার-পরিজনকে উদ্বুদ্ধ করা উচিত।
হজরত আয়েশা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে রাসুলুল্লাহ! আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী করব?’ তিনি বললেন: তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুব্বুন, তুহিব্বুল আফ্ওয়া ফা’ফু আন্নি’—অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন—অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।’ (তিরমিযি)
লাইলাতুল কদর গোটা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত পুণ্যময় রজনী। এ রাত বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর অশেষ রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভের অপার সুযোগ এনে দেয়। এ রাত হচ্ছে মহান আল্লাহর কাছে সুখ, শান্তি, ক্ষমা ও কল্যাণ প্রার্থনার এক অপূর্ব সুযোগ। এ রাতে অবতীর্ণ মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মুক্তির সনদ পবিত্র কোরআনের অনুপম শিক্ষাই ইসলামের অনুসারীদের সার্বিক কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, ইহকালীন শান্তি ও পারলৌকিক মুক্তির পথ দেখায়। অতএব, আসুন! মাহে রমজানে অফুরন্ত নিয়ামতের আধার ‘লাইলাতুল কদর’ তালাশ করতে সচেষ্ট হই এবং শেষ দশকের সম্ভাব্য বেজোড় রাতগুলোতে সমগ্র রাতব্যাপী ইবাদত-বন্দেগিতে নির্ঘুম কাটিয়ে দিই। 
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। 
dr.munimkhan@yahoo.com প্রথম আলো
সবটুকু একত্রে পড়ুন "‘লাইলাতুল কদর’ মহিমান্বিত ও শ্রেষ্ঠ রজনী"

বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ

  • ভাই গিরিশচন্দ্র অনূদিত কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ ভাই গিরিশচন্দ্র অনূদিত কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ
  • গিরিশচন্দ্র সেন গিরিশচন্দ্র সেন
  • মাওলানা আকরম খাঁ মাওলানা আকরম খাঁ
  • কেশবচন্দ্র সেন কেশবচন্দ্র সেন
1 2 3 4 5
বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ-এর বাংলায় প্রথম অনুবাদের সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে আজ থেকে এক বছর আগে। একেবারে নীরবে। কাউকে কিছু জানান না দিয়ে। অথচ গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) ছয় বছর দীর্ঘ (১৮৮১-১৮৮৬) কঠোর ও একাগ্র শ্রমে যখন কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের কাজ শেষ করেছিলেন, তখন সেটা গোটা বাংলা ভাষাভাষী সমাজে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই। কোরআন শরিফ-এর সঠিক অনুবাদ সেই প্রথম। অমন পরিশ্রমসাধ্য কাজের দৃষ্টান্ত সত্যিই এক বিরল ঘটনা। অবশ্য মাওলানা মহিউদ্দিন খান নামের একজন বিশিষ্ট আলেম পবিত্র কোরআন শরিফ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বলে যে দাবি করা হয়, তার অনুকূলে তেমন জোরালো কোনো সমর্থন বা তথ্য পাওয়া যায় না। যদি যেত, তাহলে ১৯৩৬ সালে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) কেন এ কথা বলতে যাবেন, ‘তিন কোটি মোছলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খ্রি. পর্যন্ত এ দেশের কোনো মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবি-পারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব ছিল না।...কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরুদায়িত্বভার বহন করিবার জন্য সুদৃঢ় সংকল্প নিয়া, সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন—বিধান-আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে।’ এই ঘটনার উল্লেখ শেষে মাওলানা আকরম খাঁর মন্তব্য, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
গিরিশচন্দ্রের জন্ম তখনকার ঢাকা জেলা, বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার মহেশ্বরদি পরগনার পাঁচদোনা গ্রামে। নবাব আলিবর্দী খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশে তাঁর জন্ম। ফারসি ভাষা চর্চার জন্য এই বংশের সুনাম ছিল। পাঁচ বছর বয়সেই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল। সাত বছর বয়সেই ফারসি ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করেন। ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর অনীহা ছিল। ফলে ১৩-১৪ বছর বয়সে তাঁকে মুন্সি কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮-১৯ বছর বয়সে তাঁকে তাঁর এক ভাই ময়মনসিংহে নিয়ে যান এবং ফারসি সাহিত্যে যাতে বুৎপত্তি লাভ করতে পারেন, সে জন্য একজন ভালো মওলানার হাতে তাঁকে তিনি তুলে দেন। সংসদ চরিতাভিধান-এর মতে, এরপর তিনি ময়মনসিংহ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারিতে নকলনবিশের কাজ করতেন। কিন্তু সে কাজ তাঁর ভালো লাগত না। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণের প্রভাবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন এবং গ্রহণ করেন এই ধর্মের প্রচারকের ব্রত। সর্বধর্মসমন্বয়ে উৎসাহী ভাই গিরিশচন্দ্র কেশবচন্দ্রের আদেশে ইসলাম ধর্ম অনুশীলনে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। আরবি ভাষা ও ইসলাম ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লক্ষ্নৌ যান। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর আত্মজীবনী আত্ম-জীবন-এ লেখেন, ‘মোসলমান জাতির মূল ধর্মশাস্ত্র কোরআন শরীফ পাঠ করিয়া এসলাম ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব অবগত হইবার জন্য আমি ১৮৭৬ খৃঃ লক্ষ্নৌ নগরে আরব্যভাষা চর্চা করিতে গিয়াছিলাম।’ তখন তাঁর বয়স ছিল ৪২ বছর। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ‘সুবিজ্ঞ’ বৃদ্ধ মৌলবি এহসান আলী। ‘আরব্য ব্যাকরণ এবং পারস্য দেওয়ান হাফেজের’ চর্চা করতেন তাঁর কাছে। মৌলবি এহসান আলী সাহেব গিরিশচন্দ্রকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এরপর লক্ষ্নৌ থেকে আরবি ব্যাকরণের চর্চা শেষে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানেও তিনি একজন মৌলবির কাছে আরবির পাঠ নিতেন নিয়মিত। পরে ঢাকায় এসে মৌলবি আলিমুদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে আরবের ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ নেন। এ সময়ই গিরিশচন্দ্রের কোরআন শরিফ পাঠের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বলে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাঁর পক্ষে সরাসরি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি ‘ঢাকা নগরস্থ সমবিশ্বাসী বন্ধু’ মিঞা জালালউদ্দিনের মাধ্যমে একখানা কোরআন সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তাঁর আত্ম-জীবন-এ তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এরপর আমি তফসির ও অনুবাদের সাহায্যে পড়িতে আরম্ভ করি। যখন আমি তফসিরাদির সাহায্যে আয়াত সকলের প্রকৃত অর্থ কিছু কিছু বুঝিতে পারিলাম, তখন তাহা অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।’
কোরআন শরিফ-এর বাংলায় অনুবাদের কাজটা মূলত শুরু হয় ১৮৮১ সালের শেষভাগ থেকে। গিরিশচন্দ্র তখন ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করতেন। অল্প অল্প করে অনুবাদ করে তা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করতে থাকেন। আত্ম-জীবন-এ এর বিবরণ দিয়ে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়, পরে কলকাতায় আসিয়া খণ্ডশঃ আকারে প্রতিমাসে বিধানযন্ত্রে মুদ্রিত করা যায়। প্রায় দুই বছরে কোরআন সম্পূর্ণ অনুবাদিত ও মুদ্রিত হয়। পরিশেষে সমুদয় এক খণ্ডে বাঁধিয়া লওয়া যায়। প্রথমবারে সহস্র পুস্তক মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহা নিঃশেষিত হইলে পরে ১৮৯৮ সালে কলকাতা দেবযন্ত্রে তাহার দ্বিতীয় সংস্করণ হয়। দ্বিতীয়বারের সহস্র পুস্তকও নিঃশেষিত প্রায়। এখন (১৯০৬ খ্রি.) সংশোধিত আকারে তাহার তৃতীয় সংস্করণের উদ্যোগ হইতেছে।’
অবশ্য একজন ভিন্ন ধর্মমতের ব্যক্তিপুরুষ পবিত্র কোরআন শরিফ অনুবাদ করায় তখনকার মুসলমান সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ যে ক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত হয়নি, তা নয়। হয়েছিল। কেশবচন্দ্র তাদের সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মুসলমান সমাজের প্রতি তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়বাদের মন্ত্র ও আদর্শের পক্ষে সুদৃঢ় অভিমত তুলে ধরেছিলেন। বাংলায় পবিত্র কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের ঘটনায় তিনি অপরিসীম আনন্দ পেয়েছিলেন।
তবে শিক্ষিত ও উদার স্বাধীনচেতা মুসলমানদের বৃহত্তর অংশ গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা অনুবাদে পবিত্র কোরআন শরিফ পেয়ে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল, এক অর্থে তা অভাবিত ও অভূতপূর্ব। তখনকার কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবি শিক্ষক আহমদউল্লা এবং আরও কিছু আলেম-উলেমা অনুবাদকের উদ্দেশে ইংরেজিতে যে চিঠি লিখেছিলেন, বাংলায় তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো। তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাসে ও জাতিতে মোসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতাদৃশ চেষ্টা ও কষ্টসহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদিগের অত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়।
‘কোরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণসমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমণ্ডলীর এতাদৃশ উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইলেন, তখন সেই সকল লোকের নিকটে আত্মপরিচয় দিয়া তাহার উপযুক্ত সম্ভ্রমলাভ করা উচিত।’
উল্লেখ করা যেতে পারে, পবিত্র কোরআন শরিফ ভাই গিরিশচন্দ্র অনুবাদ করেছিলেন নিজের নামস্বাক্ষরহীনভাবে। যখন তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেলেন, প্রশংসা পেলেন এবং সেটা স্বয়ং মুসলমান সমাজের কাছ থেকে, তখন তিনি স্বনামে তা প্রকাশ করলেন। এবং এ সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ‘অনুবাদকের বক্তব্যে’ বললেন, ‘আজ কোরআনের অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এতকালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রীমদাচার্য কেশবচন্দ্র সেনের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম; তিনি তাহা পাইয়া পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন ও তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন; শেষাংশ আর তাহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি এই অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিলে তাহার কত না আহ্লাদ হইত, দাসও তাহার কত আশীর্বাদ লাভ করিত।’
এর পর থেকে তিনি মুসলমান ধর্ম বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন ও অনুবাদের পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে চললেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আরবি ও ফারসি থেকে হাদিসসহ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), খলিফাবৃন্দ, মুসলমান মনীষীবর্গের জীবনীসহ অন্য বহু বিষয়ে মোট ৪২টি গ্রন্থ বাংলায় রচনা ও প্রকাশ করেন।
এর পর থেকে বাংলার মুসলমান সমাজে যাতে গিরিশচন্দ্রের বাংলায় অনূদিত কোরআন শরিফ বহুল পরিমাণে বিক্রি, প্রচার ও আদৃত হয়, তার জন্যও চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অনেক মুসলমান বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। বাংলা ১২৮৮ সনের ৬ ফাল্গুন আবুয়ল্ মজফ্র আবদুল্লাহ নামের একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি পত্র মারফত অনুবাদককে জানান, ‘মহাশয়ের বাংলা ভাষায় অনুবাদিত কোরআন শরিফ দুই খণ্ড উপহার প্রাপ্ত হইয়া অতি আহ্লাদের সহিত পাঠ করিলাম। এই অনুবাদ আমার বিচেনায় অতি উত্তম ও শুদ্ধরূপে টীকাসহ হইয়াছে। আপনি তফসীর হোসেনী ও শাহ আবদুল কাদেরের তফসীর অবলম্বন করিয়া যে সমস্ত টীকা লিখিয়াছেন এজনের ক্ষুদ্র বিদ্যাবুদ্ধিতে পর্যন্ত বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাতে বোধ করি যে, এ পর্যন্ত কোরআন শরীফের অবিকল অনুবাদ অন্য কোনোও ভাষাতেই করা হয় নাই, এবং আমি মনের আহ্লাদের সহিত ব্যক্ত করিতেছি যে, আপনি যে ধর্ম্ম উদ্দেশ্যে যার পর নাই পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এই অনুবাদ করিয়াছেন, ইহার ফল ঈশ্বর আপনাকে ইহ ও পরকালে প্রদান করুন।’
এবং ১৯৩৬ সালে যখন ভাই গিরিশচন্দ্রের কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ কলকাতা থেকে বের হচ্ছে, তার ভূমিকায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ অকপটে লিখেছেন, ‘...তখন আরবি-পারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যথেষ্ট অধিকার ছিল তাঁহাদের রচিত বা অনুবাদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই।’ পরিশেষে অনূদিত এই কোরআন শরিফ সম্পর্কে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় মন্তব্য, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
মহীয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনও (১৮৮০-১৯৩২) যারপরনাই খুশি হন বাংলায় পবিত্র কোরআন শরিফ-এর অনুবাদে। গিরিশচন্দ্রকে তিনি ‘মোসলমান ব্রাহ্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন নিঃসংকোচে। গিরিশচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁহার (রোকেয়ার) সঙ্গে আমার মাতৃপুত্র সম্বন্ধ স্থাপিত। সেই মনস্বিনী মহিলা উক্ত ঘনিষ্ঠতার পরিচয় নিজেই প্রদান করিয়া থাকেন। তিনি আমাকে পত্রাদি লিখিতে পত্রে নিজের নাম না লিখিয়া নামের পরিবর্তে “মা”, “আপনার স্নেহের মা” বলিয়া স্বাক্ষর করিয়া থাকেন।’
বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ এবং মুসলমান মনীষী ও তাঁদের অন্যান্য সাহিত্যকর্ম অনুবাদের কল্যাণে তিনি বাংলার মুসলমান সমাজে এতদূর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে ‘মৌলবি’ ও ‘ভাই’ গিরিশচন্দ্র অভিধায় অভিহিত করা হতো। সে সময়কার মুসলমান সমাজের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর জীবনীও ছাপা হয়েছে সবিস্তারে। এমন কী তাঁর মৃত্যুর পর শবানুগমন করেছিলেন ব্রাহ্ম ও মুসলমান সমাজের লোকজন সমভাবে।
গিরিশচন্দ্র সেনকে আমরা ‘মৌলবি’ কিংবা ‘ভাই’, যে বিশেষণেই বিশেষায়িত করি না কেন, বাংলার ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলমান—এই দুই বৃহৎ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়গত সেতুবন্ধনে যে সবিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তাঁর বাংলায় অনূদিত পবিত্র কোরআন শরিফ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোরআন শরিফ-এর সেই অনুবাদ-কর্মের কাল সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে খুবই নীরবে। কেউ কিছু লেখেননি। আমরা কি জাতি হিসেবে এতই কৃপণ, অনুদার এতটাই! prothom-alo
সবটুকু একত্রে পড়ুন "বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ"

মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত ও শিক্ষা

বিশ্বমানবতার ভীষণ বিপর্যয়ের এক চরম মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পৃথিবীতে শুভাগমন ঘটে। আজ থেকে এক হাজার ৪৪১ বছর আগে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট, রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখে পবিত্র মক্কা নগরের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে স্নেহময়ী মা আমিনার গর্ভে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর আগমন হয়, যখন সমগ্র আরব দেশ তথা সারা বিশ্ব অজ্ঞানতা ও পাপাচারের ঘোর তমসায় আচ্ছন্ন। নীতির নামে দুর্নীতি, শাসনের নামে শোষণ, ধর্মের নামে অধর্ম ইত্যাদি মনগড়া মতবাদের ফলে সামগ্রিকভাবে মানবসমাজ দুঃসহ বেদনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এহেন কঠিন দুর্বিষহ অবস্থায় বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ নিয়ে কোনো মহামানবের আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
মানুষ তখন মানবিক গুণাবলি ও চারিত্রিক আদর্শ হারিয়ে পশুত্বের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। এ চরম দুর্গতি থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ত্রাণকর্তারূপে বিশ্বনবীর আবির্ভাব অত্যাসন্ন ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বশান্তি, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সংহতি ও মানবতার জাগতিক, পারলৌকিক কল্যাণের সুমহান বাণীবাহক ও মুক্তিদাতারূপে তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সব দেশের, সব যুগের ও সব মানুষের নবী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠালেন। সারা বিশ্বের জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, ফেতনা-ফ্যাসাদ, অন্যায়ভাবে মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের মূলোৎপাটন ঘটিয়ে তিনি সত্য-ন্যায়ের শিক্ষা ও উত্তম আদর্শ স্থাপন করে জাগতিক শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা বিধান করেন এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণ, মুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধানদাতা ও জীবনবিধানস্বরূপ আল-কোরআন প্রদান করে ঘোষণা করেন, ‘আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের জন্য শুভ সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সূরা সাবা, আয়াত-২৮)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) সুন্দর আচরণ, উত্তম চরিত্র-মাধুর্যের দ্বারা মানবিক গুণাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেন এবং আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি ও তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে মানবজীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের পথনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি আল-কোরআনের ঐশী আলোকে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের শত শত বর্ষের পুঞ্জীভূত অন্ধকার বিদূরিত করে বিভ্রান্ত-আত্মভোলা মানবজাতিকে সত্য, সরল ও সঠিক পথপ্রদর্শন করেন। বিশ্বের অজ্ঞানতা আর মূর্খতার অন্ধকার দূরীভূত করে তিনি মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন জ্ঞান, মানুষ খুঁজে পেয়েছে পথের দিশা। মহানবী (সা.)-এর অনুপম শিক্ষায় মানুষ আল্লাহর দাসত্ব, রাসুলের আনুগত্য ও অপরাপর মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানসহকারে ভ্রাতৃত্বের মন্ত্রে উজ্জীবিত হলো।
বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-এর জীবন হচ্ছে পবিত্র কোরআনের বাস্তব রূপ। মানবজাতির মুক্তি, কল্যাণের দিশারী হিসেবে অবতীর্ণ সবশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনের যাবতীয় আদেশ-নিষেধের পূর্ণাঙ্গ বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্বনবীর জীবনে। সকল কুসংস্কার, অন্ধত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, নিপীড়ন ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে শোষণ ও বৈষম্যহীন এক ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর প্রচারিত ইসলাম মানবজাতিকে কল্যাণ, শান্তি ও প্রগতির দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তাই নবী করিম (সা.)-এর অনুপম আদর্শ সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণযোগ্য। অন্ধকার বিদূরিত করে তিনি জ্বেলেছিলেন সত্যের অনির্বাণ আলো। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, সত্য, ন্যায় ও সাম্যের বাণী প্রচার করে তিনি সারা বিশ্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-২১)
মুসলমানদের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন সমস্যা জর্জরিত মানবসমাজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সর্বস্তরের সকল সমস্যার নিখুঁত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধান পেশ করেছে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি অবতীর্ণ আল-কোরআনে জীবন সমস্যার সমাধানে বিবৃত মূল নীতিমালা প্রথমে নবীজি নিজের জীবনে অনুসরণ করেন এবং দুনিয়াবাসীর সামনে জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তব আদর্শরূপে একে তুলে ধরেন। তিনি নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মাধ্যমে মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশকে আল-কোরআনের আলোকে রূপায়িত করেছেন। সুন্দরতম চরিত্রের অধিকারী রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সূরা আল-কালাম, আয়াত-৪) প্রকৃতপক্ষে রাসুলে করিম (সা.) আল-কোরআনের জীবন্ত রূপ। আল-কোরআনকে চর্চা ও অনুশীলন করতে হলে তাঁকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন, ‘আর রাসুল তোমাদের কাছে যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং তিনি তোমাদের যা নিষেধ করেছেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭) রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও এ সম্পর্কে বাণী প্রদান করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আদর্শ আখলাক (চরিত্রাবলি) পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ (তিরমিজি)
অতএব, বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-এর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, অশেষ ভক্তি ও হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা সুদৃঢ় করা, তাঁর রেখে যাওয়া ইসলামি বিধি-বিধান তথা আল্লাহর বাণী পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মতো ঈমানি চেতনা জাগ্রত করা, যাবতীয় কর্মকাণ্ডে নবী করিম (সা.)-এর সুমহান নীতি, জীবনাদর্শ ও শিক্ষা বাস্তবায়ন করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীজিকে অনুসরণ করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com                                prothom-alo
সবটুকু একত্রে পড়ুন "মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত ও শিক্ষা"

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)

মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ শান্তি ও ন্যায়ের দিশারি

 সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র জন্ম ও ওফাতের পুণ্য স্মৃতিময় দিন আজ ১২ রবিউল আউয়াল। বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের একই দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাই এই দিনটি মুসলমানদের কাছে অশেষ পুণ্যময়, আশীর্বাদধন্য একটি দিন।
নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ন্যায়নিষ্ঠা, সততা ও সত্যবাদিতার জন্য। তিনি ছিলেন এমন একজন মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে সম্মিলন ঘটেছিল সকল মানবীয় সদ্গুণের। পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়েছিলেন। অসাধারণ চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন তিনি এবং চিন্তাকে কাজে রূপ দিতে তাঁর সমগ্র জীবন হয়ে উঠেছিল বিপুল কর্মময়।
আরব ভূখণ্ডে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক যুগে, যখন পুরো অঞ্চলটি নিমজ্জিত ছিল অশিক্ষা, কুসংস্কার, গোষ্ঠীগত হানাহানি, নির্মম দাসপ্রথা, নারীর প্রতি চরম বৈষম্যসহ নানা রকম সামাজিক অনাচারে। সেই নৈরাজ্যকর অমানিশায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে আলোর দিশারিরূপে। অন্যায়-অবিচার-অজ্ঞানতার আঁধার থেকে মানুষকে তিনি নিয়ে চলেন সত্য ও ন্যায়ের আলোকিত পথে। ইসলামের সেই আলোর দিশা ক্রমে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে। সার্বিক অর্থে মানবজাতির মুক্তি ও কল্যাণের জন্যই আবির্ভাব ঘটেছিল এই মহামানবের।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মুসলমানদের রাসুল; কিন্তু অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মানুষকেও তিনি ভালোবাসতেন সমানভাবে। তাঁর সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ ছিল সর্বমানবিক। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে মানবিক মঙ্গল সাধিত হয়; করুণা ও ভালোবাসা মানবজাতিকে হিংসা ও হানাহানি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও করুণার অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু কথায় নয়, প্রতিটি বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মনে এই শুভবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন যে, মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর এই দিনে আমরা কামনা করি মহানবী (সা.)-এর শান্তি, মিলন ও ভ্রাতৃত্বের জীবনাদর্শই হোক আমাদের জীবনের পাথেয়। মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে আমরা সব ধরনের অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি পেতে পারি, পৃথিবীর সব জাতি-সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। পৃথিবীর নানা দেশে আজ মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, শান্তি ব্যাহত হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুরতা। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং আচার-আচরণের ভিন্নতা নিয়ে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বলপ্রয়োগের প্রবণতা। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর বাণী, জীবনাদর্শ ও পুণ্য কর্মময় জীবনের দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীকে পথ দেখাতে পারে।

সবটুকু একত্রে পড়ুন "পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)"