Archive for February 2012

মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত ও শিক্ষা

বিশ্বমানবতার ভীষণ বিপর্যয়ের এক চরম মুহূর্তে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পৃথিবীতে শুভাগমন ঘটে। আজ থেকে এক হাজার ৪৪১ বছর আগে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট, রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখে পবিত্র মক্কা নগরের সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে স্নেহময়ী মা আমিনার গর্ভে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর আগমন হয়, যখন সমগ্র আরব দেশ তথা সারা বিশ্ব অজ্ঞানতা ও পাপাচারের ঘোর তমসায় আচ্ছন্ন। নীতির নামে দুর্নীতি, শাসনের নামে শোষণ, ধর্মের নামে অধর্ম ইত্যাদি মনগড়া মতবাদের ফলে সামগ্রিকভাবে মানবসমাজ দুঃসহ বেদনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এহেন কঠিন দুর্বিষহ অবস্থায় বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ নিয়ে কোনো মহামানবের আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে শান্তি, মুক্তি, প্রগতি ও সামগ্রিক কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)
মানুষ তখন মানবিক গুণাবলি ও চারিত্রিক আদর্শ হারিয়ে পশুত্বের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। এ চরম দুর্গতি থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য ত্রাণকর্তারূপে বিশ্বনবীর আবির্ভাব অত্যাসন্ন ও অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বশান্তি, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সংহতি ও মানবতার জাগতিক, পারলৌকিক কল্যাণের সুমহান বাণীবাহক ও মুক্তিদাতারূপে তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সব দেশের, সব যুগের ও সব মানুষের নবী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠালেন। সারা বিশ্বের জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার, অবিচার, ফেতনা-ফ্যাসাদ, অন্যায়ভাবে মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের মূলোৎপাটন ঘটিয়ে তিনি সত্য-ন্যায়ের শিক্ষা ও উত্তম আদর্শ স্থাপন করে জাগতিক শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তা বিধান করেন এবং বিশ্বমানবতার কল্যাণ, মুক্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে মানবজীবনের সব সমস্যার সমাধানদাতা ও জীবনবিধানস্বরূপ আল-কোরআন প্রদান করে ঘোষণা করেন, ‘আমি তোমাকে সমগ্র মানুষের জন্য শুভ সংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সূরা সাবা, আয়াত-২৮)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) সুন্দর আচরণ, উত্তম চরিত্র-মাধুর্যের দ্বারা মানবিক গুণাবলি ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেন এবং আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি ও তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে মানবজীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের পথনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি আল-কোরআনের ঐশী আলোকে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের শত শত বর্ষের পুঞ্জীভূত অন্ধকার বিদূরিত করে বিভ্রান্ত-আত্মভোলা মানবজাতিকে সত্য, সরল ও সঠিক পথপ্রদর্শন করেন। বিশ্বের অজ্ঞানতা আর মূর্খতার অন্ধকার দূরীভূত করে তিনি মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন জ্ঞান, মানুষ খুঁজে পেয়েছে পথের দিশা। মহানবী (সা.)-এর অনুপম শিক্ষায় মানুষ আল্লাহর দাসত্ব, রাসুলের আনুগত্য ও অপরাপর মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের স্থলে আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানসহকারে ভ্রাতৃত্বের মন্ত্রে উজ্জীবিত হলো।
বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-এর জীবন হচ্ছে পবিত্র কোরআনের বাস্তব রূপ। মানবজাতির মুক্তি, কল্যাণের দিশারী হিসেবে অবতীর্ণ সবশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনের যাবতীয় আদেশ-নিষেধের পূর্ণাঙ্গ বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্বনবীর জীবনে। সকল কুসংস্কার, অন্ধত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, নিপীড়ন ও দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে শোষণ ও বৈষম্যহীন এক ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি আজীবন নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর প্রচারিত ইসলাম মানবজাতিকে কল্যাণ, শান্তি ও প্রগতির দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তাই নবী করিম (সা.)-এর অনুপম আদর্শ সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণযোগ্য। অন্ধকার বিদূরিত করে তিনি জ্বেলেছিলেন সত্যের অনির্বাণ আলো। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, সত্য, ন্যায় ও সাম্যের বাণী প্রচার করে তিনি সারা বিশ্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-২১)
মুসলমানদের অনুসৃত ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন সমস্যা জর্জরিত মানবসমাজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, জাতীয়, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত সর্বস্তরের সকল সমস্যার নিখুঁত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাধান পেশ করেছে। মহানবী (সা.)-এর প্রতি অবতীর্ণ আল-কোরআনে জীবন সমস্যার সমাধানে বিবৃত মূল নীতিমালা প্রথমে নবীজি নিজের জীবনে অনুসরণ করেন এবং দুনিয়াবাসীর সামনে জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তব আদর্শরূপে একে তুলে ধরেন। তিনি নিজের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মাধ্যমে মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশকে আল-কোরআনের আলোকে রূপায়িত করেছেন। সুন্দরতম চরিত্রের অধিকারী রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সূরা আল-কালাম, আয়াত-৪) প্রকৃতপক্ষে রাসুলে করিম (সা.) আল-কোরআনের জীবন্ত রূপ। আল-কোরআনকে চর্চা ও অনুশীলন করতে হলে তাঁকে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন, ‘আর রাসুল তোমাদের কাছে যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তা তোমরা গ্রহণ করো এবং তিনি তোমাদের যা নিষেধ করেছেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক।’ (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭) রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও এ সম্পর্কে বাণী প্রদান করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আদর্শ আখলাক (চরিত্রাবলি) পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ (তিরমিজি)
অতএব, বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী (সা.)-এর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, অশেষ ভক্তি ও হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসা সুদৃঢ় করা, তাঁর রেখে যাওয়া ইসলামি বিধি-বিধান তথা আল্লাহর বাণী পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মতো ঈমানি চেতনা জাগ্রত করা, যাবতীয় কর্মকাণ্ডে নবী করিম (সা.)-এর সুমহান নীতি, জীবনাদর্শ ও শিক্ষা বাস্তবায়ন করা এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীজিকে অনুসরণ করা প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যক।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ অ্যান্ড দাওয়াহ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com                                prothom-alo
সবটুকু একত্রে পড়ুন "মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত ও শিক্ষা"

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)

মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ শান্তি ও ন্যায়ের দিশারি

 সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র জন্ম ও ওফাতের পুণ্য স্মৃতিময় দিন আজ ১২ রবিউল আউয়াল। বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের একই দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাই এই দিনটি মুসলমানদের কাছে অশেষ পুণ্যময়, আশীর্বাদধন্য একটি দিন।
নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ন্যায়নিষ্ঠা, সততা ও সত্যবাদিতার জন্য। তিনি ছিলেন এমন একজন মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে সম্মিলন ঘটেছিল সকল মানবীয় সদ্গুণের। পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে বিশ্বমানবতার মুক্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়েছিলেন। অসাধারণ চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন তিনি এবং চিন্তাকে কাজে রূপ দিতে তাঁর সমগ্র জীবন হয়ে উঠেছিল বিপুল কর্মময়।
আরব ভূখণ্ডে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক যুগে, যখন পুরো অঞ্চলটি নিমজ্জিত ছিল অশিক্ষা, কুসংস্কার, গোষ্ঠীগত হানাহানি, নির্মম দাসপ্রথা, নারীর প্রতি চরম বৈষম্যসহ নানা রকম সামাজিক অনাচারে। সেই নৈরাজ্যকর অমানিশায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে আলোর দিশারিরূপে। অন্যায়-অবিচার-অজ্ঞানতার আঁধার থেকে মানুষকে তিনি নিয়ে চলেন সত্য ও ন্যায়ের আলোকিত পথে। ইসলামের সেই আলোর দিশা ক্রমে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে। সার্বিক অর্থে মানবজাতির মুক্তি ও কল্যাণের জন্যই আবির্ভাব ঘটেছিল এই মহামানবের।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মুসলমানদের রাসুল; কিন্তু অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মানুষকেও তিনি ভালোবাসতেন সমানভাবে। তাঁর সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ ছিল সর্বমানবিক। মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে মানবিক মঙ্গল সাধিত হয়; করুণা ও ভালোবাসা মানবজাতিকে হিংসা ও হানাহানি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও করুণার অনন্য দৃষ্টান্ত। শুধু কথায় নয়, প্রতিটি বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মনে এই শুভবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন যে, মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর এই দিনে আমরা কামনা করি মহানবী (সা.)-এর শান্তি, মিলন ও ভ্রাতৃত্বের জীবনাদর্শই হোক আমাদের জীবনের পাথেয়। মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে আমরা সব ধরনের অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তি পেতে পারি, পৃথিবীর সব জাতি-সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। পৃথিবীর নানা দেশে আজ মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, শান্তি ব্যাহত হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুরতা। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং আচার-আচরণের ভিন্নতা নিয়ে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বলপ্রয়োগের প্রবণতা। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)-এর বাণী, জীবনাদর্শ ও পুণ্য কর্মময় জীবনের দৃষ্টান্ত বিশ্ববাসীকে পথ দেখাতে পারে।

সবটুকু একত্রে পড়ুন "পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)"