ঈশ্বর-ভাবনা, গোল্ডফিশের বাস্তবতা ও হকিংয়ের ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’

প্রফেসর স্টিফেন হকিংয়ের নাম এতোই সুপরিচিত যে তাঁর কোনো পরিচিতি লাগে না তারপরও কিছু বলা যায় তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর ছিলেন দীর্ঘ ৩০ বছর এই পদে নিউটন একদা অধিষ্ঠিত ছিলেন বিজ্ঞানী হিসেবে হকিং কিংবদন্তীতুল্য আইনস্টাইনের পরপরই জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর নামই সর্বাগ্রে মুখে আসে নিন্দুকেরা বলতে পারেন যে তাঁর এইক্রেইজমিডিয়ার কল্যাণে সৃষ্টি কিন্তু তারপরও তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে তাঁর অবদান কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না

সুপ্রসিদ্ধ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হকিং সম্প্রতি একটি সাড়া-জাগানো বই লিখেছেন। বইটির নামদ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন বইটি নিঃসন্দেহে কৌতূহলোদ্দীপক। এই বইটিতে তাঁর সহলেখক ছিলেন ক্যালটেকের পদার্থবিদ লেওনার্ড ম্লোদিনো। এই বইটি প্রকাশ পাবার সাথে সাথে নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে নানান বিতর্কের। বলা হয়েছে, হকিং সরাসরি ঈশ্বরকে নাকচ করে দিয়েছেন। হকিংয়ের এটাই একমাত্র বই নয়। এর আগেও তিনি বই লিখেছেন। এবং সাড়া জাগিয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ (১৯৮৮) এই বইটি সর্বমোট প্রায় নব্বুই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে। বিজ্ঞানের বইয়ের জন্য এটা একটা সাংঘাতিক রেকর্ড। মহাবিশ্বের সৃষ্টি, উৎপত্তি ক্রমবিকাশ, মহাবিশ্বে কার্যকর প্রাকৃতিক নিয়মকানুন, মৌলিক কণার ব্যাখ্যা এসব নিয়েই তিনি ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’- লিখেছিলেন। তিনি সেখানে কৃষ্ণবিবর সংক্রান্ত তাঁর তত্ত্ব এবং পদার্থবিজ্ঞানের একত্রিকরণ সর্ম্পকেও লিখেছিলেন। তারপর তিনি লিখেছেনদ্য ইউনিভার্স ইন নাটশেল’ (২০০১)

আগের বইগুলো থেকে বর্তমান বইটির চরিত্র বেশ আলাদা। এই বইয়ের ভাষা আরো সাবলীল। দৈনন্দিনের ভাষা ব্যবহার করে তিনি পাঠককে নিয়ে গেছেন আধুনিক গবেষণার একেবারে প্রান্তবিন্দুতে। ফলে -বিজ্ঞানী যে-কেউ বইটি নাড়াচাড়া করলে মহাবিশ্ব এবং তার মৌলিক চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। বইটিতে মোট আটটি অধ্যায়ে তিনি সত্তার রহস্য, বাস্তবতার স্বরূপ, সবকিছুর তত্ত্ব, মহাবিশ্বের গতি-প্রকৃতি, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আধুনিক চিন্তাধারা এবং মহাবিশ্বের মূল-নকশার বিষয় তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ আটটি অধ্যায়ের মোট দুইশ পাতায় পাঠক মানুষের চিরাচরিত জিজ্ঞাসার জবাব বিজ্ঞানের ভাষায় পেয়ে যাবেন। মজার ব্যাপার, এই অভিযাত্রায় তাকে কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্রেরই মুখোমুখি হতে হবে না। হকিংয়ের এই বইটির অনন্যতা এই দিক দিয়ে যে, এর ভাষা মোটেই ভারাক্রান্ত নয়। এমনকি হকিং নিজেই স্বীকার করেছেন যে ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমঅত সহজ বই নয় যতটা দাবী করা হয়েছিল। আর তাঁর পরবর্তী ব্রিফার হিস্ট্রি অব টাইম’ (২০০৫) বইতে তিনিব্রিফ হিস্ট্রিকেই সহজতর ভঙ্গীতে পুনরুপস্থাপন করেছেন। আর তাঁরনাটশেলবইটি বেশ জটিল। কিন্তু সেসবকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে এই বইটি।তিনি কী লিখেছেন বইয়ে? বইটি শুরু হয়েছে তিনটি প্রশ্ন দিয়ে:

মহাবিশ্বে শূন্যতার বদলে এতোকিছুর সমাহার দেখা যায় কেন? এক কথায়, মহাবিশ্ব শূন্য নয় কেন?
আমাদের সত্তার রহস্য কী?
আমরা ঠিক এইরকম ভৌতবিধি দেখি কেন, কেন অন্যরকম নয়?

তিনি বলেছেনএটিই হলো জীবন, মহাবিশ্ব এবং সবকিছু সম্পর্কে চূড়ান্ত প্রশ্নএবং এর উত্তর তিনি দেবার চেষ্টা করেছেন বইয়ে। তিনি আরো বলেছেন,‘বিশ্বকে গভীরভাবে বুঝতে হলে শুধু কীভাবে এটি আচরণ করছে তা জানাই যথেষ্ট নয়, জানতে হবে কেন ঠিক ঐভাবেই বিশ্বের বিবর্তন হচ্ছে।

বইটির শুরুতেই তিনি চমক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন জগতের রহস্য কী, আমাদের সত্তার রহস্য কী, বিশ্বজগতের নিয়মাবলি কী, জগতের উৎপত্তি কীভাবে এসবই মানুষের চিরকালীন প্রশ্ন। যুগে-যুগে এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা দেবার চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেক যুগে বিজ্ঞানীদের উত্তর পরবর্তী যুগে আরো শাণিত হয়েছে। আরো পূর্ণতা পেয়েছে। এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়েছে। যদিও এককালে এসব প্রশ্নের উত্তর দার্শনিকেরা দিতেন, কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরাই এসব প্রশ্নের যোগ্য উত্তরদাতা। আর আজকের দিনে, তিনি জানাচ্ছেন,‘দর্শনের মৃত্যু ঘটেছে।কারণ বিজ্ঞানের সাথে, বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের সাথে, দর্শনের গাঁটছড়া সেই-যে কবে ছুটে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই চিরকালীন প্রশ্নের বাস্তবসম্মত উত্তর এখন পদার্থবিজ্ঞানীই দিতে পারেন। এখানেই আমি চমকে উঠি। আরে, একথাতো আমি আগেই শুনেছি ! কয়েকমাস আগে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমাদের দেশের এক বরেণ্য বিজ্ঞানী ঠিক একথাই আমাকে বলেছিলেন। তখনো হকিংয়ের বই বেরই হয়নি! গ্রেট সায়েন্টিস্ট্স থিংক অ্যালাইক কী বলেন !

অ্যারিস্টটলের সময়ে বিশুদ্ধ চিন্তা দিয়ে জগতের সকল রহস্যের সমাধান করার প্রচলন ছিল। শুধু চিন্তা দিয়ে যে জগতের রহস্যের কুলকিনারা পাওয়া যায় না সেটা বহুকাল পর গ্যালিলেও এসে প্রমাণ করলেন। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে ভারী বস্তু হাল্কা বস্তুর তুলনায় দ্রুত মাটিতে পড়ে। কিন্তু হেলানো তলে বস্তু গড়িয়ে গ্যালিলেও প্রমাণ করেছিলেন যে মুক্তভাবে পতনশীল বস্তুর ত্বরণ ভর-নিরপেক্ষ। এই ত্বরণই অভিকর্ষজ ত্বরণ। চিন্তা সর্ঠিক কিনা তা যাচাই করে দেখার প্রয়োজনীয়তা দার্শনিক উপলব্ধি করেন নি, কিন্তু বিজ্ঞানী করেছিলেন। সেই থেকেই বিজ্ঞানের পথ দর্শনের থেকে আলাদা।

তাহলে বাস্তবতার স্বরূপ সম্বন্ধে বিজ্ঞান কী বলছে ? প্লেটো থেকে শুরু করে সবাই বাস্তবতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। প্লেটোর জগৎ ছিল ভাবনার জগৎ। তিনি মনে করতেন আমরা যা কিছু দেখি-শুনি-ঘ্রাণ নেই-স্পর্শ করি-স্বাদ নেই অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল বস্তুর এক আদি অকৃত্রিম আদর্শ রূপ আছে। তার সাথে তুলনা করেই আমরা বাস্তবতা সর্ম্পকে আমাদের ধারণা গড়ি। একটা গোলাপ কত সুন্দর সেটা সেই ভাবনার জগতের আদর্শ গোলাপের সাথে আমাদের অবচেতন তুলনা করে। এভাবে আমরা বাস্তবতা সর্ম্পকে ধারণা পাই। সকল দৃশ্য অদৃশ্য বস্তুর আদর্শ প্রতিরূপ কোথাও-না-কোথাও সত্যিই বিরাজমান এবং বাস্তবতার এই ধারণাকেপ্লেটোনিক রিয়ালিটিবলে। অন্যদিকে, ইউরোপীয় দার্শনিকদের মধ্যে রেনে দেকার্তে বলেছিলেন আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছিএও বাস্তবতার এক স্বরূপ। কিন্তু বিজ্ঞানে বাস্তবতা সেটাই যা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ দাবী করে। বাস্তবতার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানী পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিমূর্ত যুক্তির সাহায্যে গাণিতিক মডেল তৈরি করেন। তারপর সেই মডেল বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে কি-না, তা যাচাই করেন। তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী যদি পরীক্ষায় মেলে তো পাশ, নয়তো নতুন মডেলের সন্ধান করতে হবে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বাইরে কোনো বাস্তবতা আছে কি-না তা বিচার্য নয়, প্রাকৃতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তত্ত্ব বা মডেল যা বা যতটুকু বলতে পারে সেটাই বাস্তব। এই কাজে বিজ্ঞানীর সহায়ক হলো পঞ্চেন্দ্রিয় কান্ডজ্ঞান যা পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ চালাতে সাহায্য করে, এবং গাণিতিক যুক্তির সাহায্যে তৈরি করা সূত্র যা গণনা করে বলে দিতে পারে অমুক জায়গায় অমুক জিনিস অমুকভাবে পাওয়া যাবে। এইগুলোই হলো বিজ্ঞানীর হাতিয়ার বাটুল একেই বলে বাস্তবতার মডেল-ভিত্তিক ব্যাখ্যা। বাস্তবতার এই ব্যাখ্যা অনেক বিজ্ঞানীর কাছেই পছন্দের নয়। অনেক বিজ্ঞানীও মনে করেন যে তত্ত্ব-নিরপেক্ষ এক চিরকালীন বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু হকিং বলছেন যে এই প্লেটোনিক বাস্তবতার কোনো মানে নেই এবং এই অলীক ধারণা ত্যাগ করার সময় এসেছে।
আমরা কীভাবে বুঝব যে আমাদের তত্ত্ব বা মডেল সঠিক কি-না ? অর্থাৎ একটা ভালো মডেলের কী কী গুণাগুণ থাকা উচিত ? একটা মডেল তখনই ভালো মডেল হবে যদি এটি ) সুচারু সর্বাঙ্গীন সুন্দর হয়, ) যদৃচ্ছ প্যারামিটারের সংখ্যা কম হয়, ) সকল (কিংবা নিদেনপক্ষে অধিকাংশ) পর্যবেক্ষণের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম, এবং ) তত্ত্বটির ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ভালো হতে হবে, অর্থাৎ মডেলটি এমনসব ভৌতঘটনার কথা বলবে যা পর্যবেক্ষণ করে বলা সম্ভব মডেলটি ঠিকঠাক আছে কি-না। এই নিরিখে প্রাচীন ঋষিদের ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমের সমন্বয়ে গঠিত জগৎ-মডেল কোনোমতেই ভালো মডেল নয়। এভাবে যাচাই-বাছাই করে যেসব মডেল টিকে যায় তারা বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের যা বলতে পারে, সেটাই বাস্তবতার আপাত স্বরূপ বলে গণ্য হবে। এটাই হকিংয়ের কথা।

প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করা যায়। কয়েক বছর আগে ইতালির এক ছোট শহরের পৌরসভা তাদের নাগরিকদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, যাদের বাসায় অ্যাকুইরিয়াম আছে তারা যেন গোল স্বচ্ছ বাটিতে গোল্ডফিশ না রাখেন। তাতে করে গোল্ডফিশের মনে বাস্তবতা সম্পর্কে একটা বিকৃত ধারণা জন্মায়। কারণ গোলাকার বাটি থেকে বহির্বিশ্বের এক অঋজু প্রতিবিম্ব পাওয়া যায় যা প্রকৃত বাস্তবসম্মত নয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি গোল্ডফিশের থেকে ভালো বা স্পষ্ট কিছু দেখি ? আমরাও কি বহিবির্শ্ব সম্পর্কে ধারণার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের উপর নির্ভরশীল নই ? তাহলে গোল্ডফিশে আর আমাতে পার্থক্য কোথায়।
আমরাও কিন্তু প্রকৃতি সম্পর্কে একটা অবচেতন মডেল তৈরি করি। প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় যে সব সংকেত পায়, আমাদের মস্তিষ্ক সেই সংকেত নিয়ে বহিবির্শ্ব সম্পর্কে আমাদের একটা মডেল দেখায়। এটাই আমাদের মানসিক চিত্র। যেমন দৃষ্টিশক্তির কথা যদি বিবেচনা করি। আমাদের দুচোখের রেটিনায় যে ছবি ধরা পড়ে সেই দ্বিমাত্রিক ফ্রেম অপটিক নার্ভ বেয়ে আমাদের মস্তিষ্কে যায়। অপটিক নার্ভের পেছনে যদি একটা ক্যামেরা রাখা যেত তাহলে আমরা দেখতে পেতাম চোখের রেটিনা দৃশ্যপটের কেমন ছবি তুলছে। রেটিনা যে ছবি মস্তিষ্কে পাঠায় তা খুবই খারাপ, তার অনেক পিক্সেলই কালো। মোট কথা, রেটিনা একটা টুটাফাটা ছবিই মস্তিষ্কে পাঠায়। মস্তিষ্কের ইমেজ প্রসেসিং এতো উন্নতমানের যে টুটাফাটা দ্বিমাত্রিক ছবি থেকে তা একটা রঙিন সুন্দর ত্রিমাত্রিক ছবি আমাদের উপহার দেয়। এভাবে মস্তিষ্ক বহির্বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের মানসিক চিত্র বা মেন্টাল ইমেজ তৈরি করতে সাহায্য করে। কাজেই এক অর্থে বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝি তা আমাদের মস্তিষ্কেই তৈরি হচ্ছে। কাজেই বাস্তবতার এক ঐশী মডেল আছে এই ভাবনাটা, মনে হয়, ত্যাগ করাই ভালো।

এই তত্ত্ব-নির্ভর বাস্তবতার মূলে রয়েছে আমাদের সুন্দর তত্ত্বসমূহ। তাহলে প্রশ্ন জাগে, যে মডেলগুচ্ছ প্রকৃতির বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের আভাস দেয় সেই তত্ত্ব বা তথাকথিত মডেলগুলো কী ? এই তত্ত্বগুলো আছে বলেই আমরা প্রকৃতির ক্রিয়াকর্ম বুঝতে পারি, তাকে কাজে লাগিয়ে লাগসই প্রযুক্তি বানাতে পারি এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন বিকাশ ঘটাতে পারি। কার্যকর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব না থাকলে আজকের এইডিজিটাল সভ্যতাথাকতই না। আইনস্টাইন বলেছিলেনবিশ্বকে যে কেন বোঝা যায় সেটাই বোধগম্য নয়।আর হকিং জবাবে বলেছেন, ‘বিশ্বকে বোঝা যায় তার কারণ বিশ্ব বৈজ্ঞানিক রীতিনীতি মেনে চলে, অর্থাৎ বিশ্বের আচরণকে মডেল করা সম্ভব। এইরকম মডেলগুচ্ছের প্রথমটি হলো ১৬৮৭ সালে প্রদত্ত নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। এই মহাকর্ষ শক্তির ফলে গাছের আম মাটিতে পড়ে এবং গ্রহ-নক্ষত্র যার যার নিজস্ব কক্ষপথে অধিষ্ঠিত থাকে। কাছে-দূরের ভর-বিশিষ্ট সকল বস্তুই মাধ্যাকর্ষণের আওতায় পড়ে, তাই এই আইনের নাম বিশ্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র। দ্বিতীয় যে মডেলটি আমরা পাই তা হলো বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় ধর্মাবলি সম্পর্কে আমাদের মডেল। এই মডেল একাধিক বিজ্ঞানীর হাতে পরিপক্কতা পেয়েছে। বিশেষ করে, মাইকেল ফ্যারাডে প্রচুর সংখ্যক পর্যবেক্ষণ করে পদার্থের বৈদ্যুতিক ধর্ম চুম্বকের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন করেন। চৌম্বক বলরেখার আবিষ্কার ফ্যারাডের অমর কীর্তি। বিজ্ঞানীদের এমন কিছু কীর্তি থাকে যেগুলো অসাধারণ, যেখানে চিন্তা কল্পনার অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে, যেগুলো যুগান্তকারী। ফ্যারাডের পর্যবেক্ষণগুলো মামুলি না হলেও যুগান্তকারী আবিষ্কার নয়। ফ্যারাডে যদি না করতেন, তবে অন্য কেউ পরবর্তীকালে ঠিকই এসব খুঁজে পেতেন। কিন্তু বলরেখার মতো একটা সম্পূর্ণ বিমূর্ত কনসেপ্ট দাঁড় করানো ফ্যারাডে ছাড়া হয়ত সম্ভব হত না। এজন্যই তিনি যুগান্তকারী। যেমন অনেকেই বলেন আইনস্টাইন না হলেও অন্য কেউ (যেমন লোরেন্স বা পঁয়কারে) আপেক্ষিকতার বিশেষ সূত্রাবলি আবিষ্কার করলেও করতে পারতেন। কারণ মাইকেলসন-মর্লির বিখ্যাত পরীক্ষার সাহায্যে আলোর দ্রুতির ধ্রুবত্ব প্রতিষ্ঠা স্থানাংকের আপেক্ষিকতার ধারণাকে খুব জোরালো একটা ভিত্তি দেয়। কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব এক অসাধারণ কবিতা ! তাই আইনস্টাইন যুগান্তকারী



যাহোক ১৮৬০ দশকে আরেক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটান জেম্স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। তিনি চারটি অনবদ্য সমীকরণ প্রস্তাব করেন যা বস্তুর চুম্বকত্ব বৈদ্যুতিক ধর্মাবলিকে একই বিদ্যুৎ-চুম্বক বলের ভিন্ন বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ম্যাক্সওয়েলের এই চারটি সমীকরণ একইসাথে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বিকিরণ, সম্পুর্ণ ইলেকট্রিকাল এঞ্জিনিয়ারিং, বিদ্যুৎ-শক্তি, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ব্যাখ্যা করে। প্রকৃতির বলসমূহের একীভবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ম্যাক্সওয়েল প্রথম মাইলফলকটি রচনা করেন। এরপর আমরা পাই আইনস্টাইনের মহাকর্ষ আইনের সাধারণ তত্ত্ব যেখানে তিনি বস্তুর ভরকে স্থান-কালের বক্রতার সাথে সম্পর্কিত করেন। এই দুটি প্রধান বল ছাড়াও প্রকৃতিতে আরো দুটি মৌলিক বল আছে যারা পরমাণুর অন্দরমহলে কাজ করে। কারণ, এদের পাল্লা বড়ই ক্ষুদ্র। এরা হলো সবল নিউক্লিয় বল (যা পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠনে সাহায্য করে) এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল (যা তেজস্ক্রিয়তার জন্য দায়ী) পরমাণুর অভ্যন্তরে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সবল নিউক্লিয় বল, তারপর বিদ্যুৎ-চুম্বক বল, তারপর দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং সবচেয়ে ক্ষীণ হলো মহাকর্ষ শক্তি। বৃহৎ স্কেলে এই মহাকর্ষই মহাবিশ্বকে বর্তমান চেহারা দিয়েছে, কিন্তু পরমাণুর খপ্পরে সে অতীব ক্ষীণ।
বিজ্ঞানীদের এই এক তুরীয় ধারণা যে, প্রকৃতির সকল বল আসলে একটি একক মূল-বলের বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ একটা মূল-বল আছে যা ভিন্ন ভিন্ন ভৌত শর্তের অধীনে ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নেবে। এই ভাবনাটিকে অনেকেই প্লেটোনিক রিয়ালিজমের অনুরূপ ভাবেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ ১৯৬০ দশকে আব্দুস সালাম, স্টিভেন ওয়েইনবার্গ শেলডন গ্ল্যাশো দেখিয়েছেন যে বিদ্যুৎ-চুম্বক বল দুর্বল নিউক্লিয় বল আসলে একই বলের দুটি ভিন্ন রূপ। এরপর বিজ্ঞানীরা এমন এক তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন যাতে করে সবল নিউকিøয় বলকেও অপর দুটি একীভূত বলের সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায়। এই তত্ত্বের নামগাটবা গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি অথবা অনেকে একে স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলে। এই মডেলেরই প্রমাণ খুঁজছে জেনেভার লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। সুতরাং বিজ্ঞানীদের দোষী করা যায় না, যদি তাঁরা ভাবতে চান যে আসলেই প্রকৃতির সকল বল একটি একক বলের বহিঃপ্রকাশ। এবং আমাদের সকল কার্যকর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা মডেলের মূলে আছে এক চূড়ান্ত তত্ত্ব বা মডেল যাকে বলেসবকিছুর তত্ত্ব অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন এই থিওরি অব এভ্রিথিংই হবে আমাদের সেই স্বপ্নের সোনার হরিণ। এর সাহায্যে আমরা প্রকৃতির সকল প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা পাবো। প্রকৃতি বড়ই সৌন্দর্যপ্রিয় এবং সে অঙ্কের ভাষা খুব ভালো বোঝে। প্রকৃতির সবকিছুতেই একটা অতুলনীয় প্রতিসাম্য কাজ করে, তাই প্রকৃতি বাহুল্য পছন্দ করে না। কাজেই বিজ্ঞানীরা যদি ভাবতে ভালো বাসেন যে আসলে একাধিক মডেল নয়, মূল মডেল একটিই একাধিক বল নয়, প্রাচীন আদ্যাবল একটিই, তো আপনি কি একে অযৌক্তিক বলবেন?

কিন্তু সমস্যা হলো, স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কিছুতেই মহাকর্ষকে ঢোকানো যাচ্ছে না। বেয়াড়া গরুর মতো সে কেবলই এদিক-ওদিক ঢুসঢাস দিচ্ছে। কিছুতেই গোয়ালে ঢুকছে না, তাই বেচারা গেরস্তও দরজাটি লাগিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরতে পারছে না। দেখা যায়, অন্য তিনটি বলের সার্থক কার্যকর কোয়ান্টাম তত্ত্ব থাকলেও কোয়ান্টাম মহাকর্ষের কোনো তত্ত্বই কার্যকর করা যাচ্ছে না। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে কিছুতেই বাগ মানিয়ে পরমাণুর ভেতরে ঠেলে দেওয়া যাচ্ছে না। সবকিছুর তত্ত্বের অধীনে সকল বলের একীভবনের এই স্বপ্নের সোনার হরিণের পেছনে আইনস্টাইন তাঁর জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন। নাহ, স্বপ্নের হরিণ তাঁকে ধরা দেয়নিসে যে নাগাল পেলে, পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁধা

স্ট্যান্ডার্ড মডেল আমাদের কী বাস্তবতা উপহার দেয়? বাটির মধ্যে থেকেও কি বুদ্ধিমান গোল্ডফিশের পক্ষে স্ট্যান্ডার্ড মডেল পাওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। পর্যাপ্ত দীর্ঘকাল প্রকৃতি সম্পর্কে শৃঙ্খলাবদ্ধ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে গোল্ডফিশের পক্ষেও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব। বাস্তবিকই আমাদের নিজেদের সাথে গোল্ডফিশের খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরাও বিশ্বকে দেখি একটি সাধারণ তারার একটি ক্ষুদ্র গ্রহ থেকে এবং সৌরজগতের অবস্থান আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বাইরের দিকে। কাজেই গোলবাটির মধ্যে থেকে পৃথিবীকে গোল্ডফিশ যেভাবে পর্যবেক্ষণ করে, আমরাও ঠিক একইভাবে বিশ্বজগৎকে দেখি।
কিন্তু আমাদের অবস্থানই বা মহাবিশ্বে কতখানি প্রান্তিক ? বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে আমাদের পৃথিবীর কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে যাতে করে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। সূর্য একটা মাঝারি মানের নক্ষত্র যার জীবনকাল প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর এবং এই দীর্ঘ জীবনকালের একটা বড় সময় সূর্য খুব সুস্থির থাকে। সূর্যের মাঝে যদি চাঞ্চল্য জাগত, তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রাও ভীষণভাবে ওঠানামা করত। প্রাণ সৃষ্টির জন্য সেটা মোটেই উপযুক্ত হতো না। প্রাণ সৃষ্টির জন্য চাই একটা খুব তুলতুলে পরিবেশের। যেমন পৃথিবী সূর্য থেকে যে দূরত্বে অবস্থিত সেই দূরত্বে পৃথিবীতে যে তাপমাত্রার সৃষ্টি হয় তাতে পানির মতো একটা বিশ্বজনীন জৈব দ্রাবককে কঠিন-তরল-বায়বীয় এই তিন দশাতেই পাওয়া যায়। তুলনায় শুক্রগ্রহ বা মঙ্গলের বৈরী পরিবেশ চিন্তা করা যায়। শুক্র সূর্যের খুব বেশি কাছে, ফলে সেখানে টেকটোনিক অ্যাকটিভিটি বেশি, তাই গ্রিনহাউজ গ্যাসও বেশি জমা হয়েছে বাতাবরণে। ফলে সেখানকার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪৫০ সেন্টিগ্রেড যেটা প্রাণ-বান্ধব নয়। অন্যদিকে, মঙ্গল এতো দূরে যে সেখানে পানি হয় জমাটবদ্ধ বরফ নয়তো ভূ-গর্ভের অভ্যন্তরে প্রবহমান। এই দুই পরিবেশ অণুজীবের পক্ষে সহায় হলেও মানুষের মতো বহুকোষী উন্নত প্রাণীর উন্নত সভ্যতার জন্য উপযুক্ত নয়। ছায়াপথের অন্যান্য নক্ষত্রে গ্রহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেও যদি গ্রহগুলোবাসযোগ্য পরিবেশেথাকে তবেই সেখানে প্রাণ সৃষ্টি হবে এবং বিবর্তনের ধারায় উন্নত প্রাণীর উদ্ভব হবে। কিন্তু প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক এই পরিবেশের উপস্থিতি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়, কোনো পারিবেশিক সমাপতনও নয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, আমাদের বিশ্বের ভৌত বিধিগুলোও এমন যে তা প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক। যেমন, সকল নিউক্লিয় বল যদি আরো শক্তিশালী হতো বা দুর্বল হতো, তাহলে হয় হাইড্রোজেনের থেকে ভারী আর কোনো মৌল সৃষ্টি হতে পারত না নতুবা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়াই অসম্ভব হতো (ফলে কোনো নক্ষত্র কোনোদিন জ্বলে উঠত না) মহাকর্ষ বল যদি আরেকটু জোরালো হত, তাহলে সৌরজগৎ আরো ছোট পরিসরের হতো এবং সেক্ষেত্রে স্থায়ী কক্ষপথের অস্তিত্ব থাকত না, গ্রহে-গ্রহে সংঘর্ষের হার বেড়ে যেত। যদি মহাকর্ষ আরেকটু দুর্বল হতো তাহলে কক্ষপথগুলো আরো দূরে দূরে থাকত, গ্রহগুলোর তাপমাত্রা খুবই কম হতো এবং গ্রহগুলোর কক্ষপথ ত্যাগের সম্ভাবনা বেশি হতো। তাছাড়া নক্ষত্রের ভেতরকার বিকিরণ মহাকর্ষের চাপের সুস্থিতিও গড়বড় হয়ে যেতো, এবং এতে করে নক্ষত্রের আয়ুষ্কাল কমে যেত। আমরা কার্বন-ভিত্তিক প্রাণী। এই কার্বনের অস্তিত্বই থাকত না যদি সবল নিউক্লিয় বলের শক্তি .% এদিক-ওদিক হতো কিংবা বৈদ্যুতিক শক্তি % কম-বেশি হতো। শুধু চারটি বলের শক্তি-প্রাবল্যের হেরফেরই নয়, দেখা যায় মহাবিশ্বের অন্য প্যারামিটারগুলোর (যেমন ইলেকট্রনের চার্জ, প্রোটনের ভর, আলোর দ্রুতি) মান যদি কিছুটা অন্যরকম হতো, তবে বুদ্ধিমান প্রাণী এই বিশ্বের কোথাওই সৃষ্টি হতে পারত না। এভাবে বৈজ্ঞানিক মডেল ব্যবহার করে যদি কৃত্রিম বিশ্ব-পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যায় এবং সেখান থেকে জানা যায় যদি মৌলিক বলসমূহ অন্যরকম হতো বা ধ্রুবরাশিগুলির মান একটু এদিক-ওদিনক হতো, তবে বিশ্ব কেমন হতো। তাই হকিং বলেন, ‘প্রকৃতির ভৌত বিধিসমূহ এমন এক সিস্টেম উপহার দিয়েছে যা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সমন্বিত বা ফাইন-টিউন্ড্। এই ভৌত বিধিগুলির সামান্য পরিবর্তন ঘটালেই আমাদের অতি পরিচিত এই জীবনের অস্তিত্বই নস্যাৎ হয়ে যায়। কাজেই ভৌতবিধিসমূহে একাদিক্রমে যদি এইসব কাকতালীয় সমাপতন না থাকত, তবে মানুষ এবং এইরকম অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব কোনোদিনই সম্ভব হতো না।এই ধরনের বিশ্বকে তাই বলেগোল্ডিলক্সের বিশ্ব

ভিক্টোরিয় যুগের এক সুপরিচিত গল্পে গোল্ডিলক্স নামের এক কিশোরী বনের মধ্যে পথ হারিয়ে এক ভালুক-দম্পতির বাসা খুঁজে পায়। সেখানে সবকিছুই তিন রকমের বাবা-ভালুকের জন্য খাবারটা খুব গরম, বিছানাটা খুব শক্ত, চেয়ারটা খুব কঠিন, মা-ভালুকের জন্য খাবারটা খুব ঠান্ডা, বিছানাটা খুব নরম, চেয়ারটা খুব নরম। কিন্তু বাচ্চা-ভালুকের খাবারটা না-গরম-না-ঠান্ডা, বিছানাটা না-নরম-না-শক্ত, চেয়ারটা অতিশয় আরামপ্রদ। অর্থাৎ বাচ্চা-ভালুকের জিনিসগুলো একদম ঠিক। গোল্ডিলক্সের সেটাই পছন্দ। আমাদের বিশ্বও এরকম ঠিক গোল্ডিলক্সের মতোজাস্ট রাইট এই সমাপতন খুব স্বাভাবিকভাবেই অতীন্দ্রিয় ভাবুকদের তুরীয় ভাবনাকে উৎসাহিত করে।

কিন্তু গোল্ডিলক্সের বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? বিজ্ঞান তো তুরীয় ভাবনায় চলে না। এখানেই হকিং তাঁরওস্তাদের মারমেরেছেন এই বইতে। তিনি বলেছেন স্ট্রিং থিওরির এক সম্প্রসারণ যার নামএম থিওরিএই এম-থিওরিই দিতে পারে এই সমস্যার সমাধান। এইএমশব্দের অর্থ কী তা কেউ জানে না হতে পারে এটামাদারবামিরাকেলবা অন্যকিছু। এম-থিওরি পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন স্ট্রিং থিওরির একত্র সমাবেশ। প্রতিটি তত্ত্বই একটি নির্দিষ্ট পরিসরের ভৌত ঘটনাবলি ব্যাখ্যা করে, কিন্তু সবগুলোকে নয়। এভাবে বাস্তবতার একটা পরস্পর-বিযুক্ত চিত্র পাওয়া যায়। হকিং বলছেন যে একটিমাত্র তত্ত্বে বা একসেট সুচারু-সমীকরণ সমস্ত বিশ্বকে ব্যাখ্যা করবে এই প্লেটোনিক ভাবনা বাদ দিয়ে আমাদের উচিত হবে এম-থিওরি মডেল-নির্ভর বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। এই বাস্তবতা অনন্য বাস্তবতা নয়। জগতের স্বরূপ নির্ভর করে কী মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা হচ্ছে তার উপর।

এই এম-থিওরিই আমদেরসবকিছুর তত্ত্ব একইসাথে এই এম-থিওরি বহুসংখ্যক মহাবিশ্বের কথা বলে। এই অনুসিদ্ধান্তের নাম মাল্টিভার্স থিওরি। এই থিওরি বলে আমাদের বিশ্ব ছাড়াও আরও প্রায় ১০^৫০০ বিশ্ব আছে যাদের ভৌত বিধিমালা ধ্রুবরাশিগুলি আলাদা। এদের মাত্র গুটিকয়েক নমুনা-বিশ্বেই প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব যাদের নিয়মকানুন প্রাণ সৃষ্টির সহায়ক। ঠিক সে কারণেই ঐরকম এক বিশ্বে আমাদের উদ্ভব হয়েছে, আর কিছু নয়। উক্ত এম-থিওরিতে দেশকালের মাত্রা এগারো চারটি ভিন্ন বাকি সব মাত্রা অত্যন্ত ক্ষুদ্রস্কেলে প্রকাশ পায়। এটাইদ্য গ্রান্ড ডিজাইনেহকিংয়ের কহতব্য বিষয়। হকিংয়ের জবানিতে শুনুন:“কয়েকশবছর পূর্বে নিউটন দেখিয়েছিলেন যে গাণিতিক সমীকরণের সাহায্যে পৃথিবীতে ব্যোমে, বস্তুর মিথস্ক্রিয়ার সুন্দর সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন যে তাহলে সঠিক তত্ত্বটি যদি জানা থাকে এবং যদি বিশাল গণনা করার জন্য উপযুক্ত ক্ষমতা থাকে, তবে পুরো মহাবিশ্বের ভূত-ভবিষ্যৎ আমরা জেনে ফেলতে পারব। তারপর এলো কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা, বক্র স্থান, কোয়ার্ক, স্ট্রিং তৎসংলগ্ন (দেশকালের) অতিরিক্ত মাত্রা এবং এদের সম্মিলনে পাওয়া যায় ১০^৫০০ বিশ্ব যাদের প্রতিটির নিয়মকানুন একে অপর থেকে আলাদা, এবং যাদের কেবল একটিই হলো আমাদের এই দৃশ্যমান জগৎ। কিছু সাধারণ সহজ অনুমিতির উপর নির্ভর করে গড়ে তোলা যায় এমন একটি একক তত্তে¦ অস্তিত্ব থাকবে যা আমাদের এই জগতের সকল আপাত নিয়মকানুনকে ব্যাখ্যা করবে পদার্থবিদদের এই চিরকালীন স্বপ্নকে এখন বোধ হয় বাদ দেওয়াই ভালো।

তার বদলে, হকিং বলছেন, এম-থিওরি-ভিত্তিক বাস্তবতাই মেনে নেওয়া শ্রেয়, যদিও এম-থিওরির এখনো পর্যবেক্ষণসম্মত প্রমাণ মেলেনি। এম-থিওরির প্রতি হকিংয়ের সমর্থনের কারণ এটি বিশ্বেরআপাত অলৌকিকসমাপতনকে ব্যাখ্যা করে, এটি বাস্তবতার একটি ব্যাখ্যা দেয়, সর্বোপরি এটি মহাকর্ষ-জাতীয় বলকে অন্য বলগুলোর সাথেও একীভূত করে। মহাকর্ষ-জাতীয় বলের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, কারণ এই বলই পারে শূন্য থেকে বিশ্বকে সৃষ্টি করতে। ১৯৮৮ সালে হকিং তাঁর ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বলেছিলেন যে সবকিছুর তত্ত্ব পেলে আমরাঈশ্বরের মনবুঝতে পারব। এখন তিনি বলছেন যে এম-থিওরি যদি শেষতক পাশ করে তবে সেটাই হবেসবকিছুর তত্ত্বএবংতাহলে আমরা বলতে পারব যে আমরা বিশ্বের মূল নকশাটি খুঁজে পেয়েছি এই মূল নকশার খোঁজই হকিং ম্লোদিনোদ্য গ্র্যান্ড ডিজাইনবইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
তাহলে গোলবাটিতে থাকা গোল্ডফিশের সাথে আমাদের খুবই মিল বলা যায়। গোলবাটির পানিতে থেকেও বুদ্ধিমান গোল্ডফিশ এই জগতের ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। আমরাও বিশ্বের এক সাধারণ গ্যালাক্সির ততোধিক সাধারণ গ্রহের বাসিন্দা হয়েও কেবল বিমূর্ত যুক্তির নিরিখে ১০^৫০০ সংখ্যক বিশ্ব সম্পর্কে এমনকি চিন্তা করতেও পারছি। এটাই আমাদের সার্থকতা এবং অবশ্য সেটা গোল্ডফিশেরও সার্থকতা। কারণ, গোলবাটির পরিবর্তে সাধারণ পাত্রে রাখলে তার পক্ষে জগতের ব্যাখ্যা সহজ হবে এজন্য যে বাটির গোলকত্বের কারণে সৃষ্ট প্রতিফলন-প্রতিসরণের অতিরিক্ত ঝামেলা থেকে সে মুক্ত।

এইবার আসা যাক মিডিয়ার খবরে। হকিং ম্লোদিনোদ্য গ্র্যান্ড ডিজাইনবইটি প্রকাশিত হওয়ার আগে থেকেই মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই পত্রিকার প্রথম পাতায় বইটি সংবাদ হয়েছে। অবশ্য খ্যাতি স্টিফেন হকিংয়ের কাছে নতুন বিষয় নয়। কিন্তু এবারেরটি একটু আলাদা। কারণ, এবারে হকিংয়ের প্রতিপক্ষ স্বয়ং ঈশ্বর। যেমন, টাইম্স পত্রিকার শিরোনামহকিং : গড ডিড নট ক্রিয়েট ইউনিভার্স।তাছাড়া আর্চবিশপ থেকে শুরু করে নানা বয়েসী মানুষ বুঝে-না-বুঝে পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগ, অন্তর্জালের সামাজিক ওয়েবসাইটগুলো (ফেসবুক, টুইটার), ব্লগে-ব্লগে কমেন্টে সয়লাব করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টেলিভিশনের টক-শো কথা তো বাদই দিলাম। সব জায়গায় একই কথা, হকিং ঘোষণা দিয়েছেন ঈশ্বর নেই। হকিং এবং ম্লোদিনো তাঁদের পুরো বইয়ে কোথাওই বলেননি যে ঈশ্বর নেই। একজন বিজ্ঞানী যেভাবে ভৌত প্রপঞ্চের ব্যাখ্যা খোঁজেন, ঠিক সেভাবেই ওঁরা এই বইয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়াস পেয়েছেন। প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক গল্প বলা যায়। লাপ্লাস যখন তাঁর বিখ্যাত নভোমন্ডল বিষয়ক গ্রন্থটি নেপোলিয়নের হাতে দিলেন, তখন সম্রাট ওঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, এতে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে কি ? জবাবে লাপ্লাস বলেছিলেন, মান্যবর, অনুমানের কোনো প্রয়োজন পড়েনি। এটাই বিজ্ঞানের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। ঠিক এই ঐতিহ্যই হকিং তাঁর বইতে বজায় রেখেছেন। কোনো ঐশী প্রভাবের বাইরে থেকে এই জগতের ব্যাখ্যা অনুসন্ধানই বিজ্ঞানের রীতি। কিন্তু মিডিয়া বৃথাই প্রচারের পারদ চড়িয়েছে। সিএনএনএর ল্যারি কিংকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছেন যে, হ্যাঁ, ঈশ্বর থাকতে পারেন, কিন্তু শুধু বিজ্ঞান দিয়েও মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এটাই বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্য।

আর দার্শনিকরা বেজায় খেপেছেন দর্শনকেমৃতবলায়। এমনকি তাঁর বইকেদার্শনিক ছেলেমানুষীবলে অনেকে গাল পেড়েছেন, কেউ হকিংকেদিব্যজ্ঞানীবলেও ব্যঙ্গ করেছেন। আর বিজ্ঞানীরা ? অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এই বইটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ফিজিক্সের অধ্যাপক জেম্স ট্রেফিলদ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’- লিখেছেন,‘এই বইটি কোনো সমীকরণ ছাড়াই আধুনিক কসমোলজির গভীরতম প্রশ্নগুলোর আলোচনায় নিয়ে যায়।স্ট্যানফোর্ডের বিখ্যাত পদার্থবিদ লিওনার্ড সাসকিন্দ বলেছিলেন যে সবকিছুর তত্ত্বের খোঁজ এখনই শেষ হয়ে যায়নি। তাছাড়া স্ট্রিং থিওরির সমালোচকরা তো আছেনই। বলা বাহুল্য, স্ট্রিং থিওরি সকলের পছন্দ নয়। নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। এমনকি একটি বইও বেরিয়েছে যার নামনট ইভেন রং অর্থাৎ স্ট্রিং থিওরি ঠিকও না, ভুলও না। তাহলে এটা কী ? ঠিক না কারণে যে এর কোনো পরীক্ষণলব্ধ প্রমাণ হাজির করা যায়নি, ভুল নয় কারণে যে এর গাণিতিক ফ্রেমওয়ার্কে কোনো ফাঁক নেই। তাই এম-থিওরির সমর্থক এখনো সবাই হয়ে ওঠেননি। তবে একটা ব্যাপার দৃষ্টি কেড়েছে, স্ট্রিং থিওরির সমালোচনা সত্ত্বেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসরশিপের পদটি হকিংয়ের পর মাইকেল গ্রিনকে দেওয়া হয়েছে যিনি প্রথম দিককার একজন স্ট্রিং থিওরিস্ট।
এই বইয়ে হকিং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন যে বিশ্বের একটা ডিজাইন আছে, কিন্তু এই ডিজাইনের উৎপত্তি হয়েছে আরো অনেক অগুণতি বিশ্বের সাথে এবং এই নকশা এম-থিওরির গণিত থেকেই আসে। কিন্তু এই এম-থিওরির অস্তিত্ব, অনেকটা ঈশ্বরের মতোন, সুপ্রমাণিত নয় তাহলে কৌতুকচ্ছলে কি বলা যায় না যে, বিশ্বের মূল কথা সেই একইথোড়-বড়ি-খাড়া, খাড়া-বড়ি-থোড়!সুত্র: http://sonarbangladesh.com

Leave a Comment