Showing posts with label আল কোরআন. Show all posts

বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ

  • ভাই গিরিশচন্দ্র অনূদিত কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ ভাই গিরিশচন্দ্র অনূদিত কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ
  • গিরিশচন্দ্র সেন গিরিশচন্দ্র সেন
  • মাওলানা আকরম খাঁ মাওলানা আকরম খাঁ
  • কেশবচন্দ্র সেন কেশবচন্দ্র সেন
1 2 3 4 5
বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ-এর বাংলায় প্রথম অনুবাদের সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে আজ থেকে এক বছর আগে। একেবারে নীরবে। কাউকে কিছু জানান না দিয়ে। অথচ গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) ছয় বছর দীর্ঘ (১৮৮১-১৮৮৬) কঠোর ও একাগ্র শ্রমে যখন কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের কাজ শেষ করেছিলেন, তখন সেটা গোটা বাংলা ভাষাভাষী সমাজে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই। কোরআন শরিফ-এর সঠিক অনুবাদ সেই প্রথম। অমন পরিশ্রমসাধ্য কাজের দৃষ্টান্ত সত্যিই এক বিরল ঘটনা। অবশ্য মাওলানা মহিউদ্দিন খান নামের একজন বিশিষ্ট আলেম পবিত্র কোরআন শরিফ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বলে যে দাবি করা হয়, তার অনুকূলে তেমন জোরালো কোনো সমর্থন বা তথ্য পাওয়া যায় না। যদি যেত, তাহলে ১৯৩৬ সালে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) কেন এ কথা বলতে যাবেন, ‘তিন কোটি মোছলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা তাহাতে কোরআনের অনুবাদ প্রকাশের কল্পনা ১৮৭৬ খ্রি. পর্যন্ত এ দেশের কোনো মনীষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে নাই। তখন আরবি-পারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব ছিল না।...কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাঁহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই। এই গুরুদায়িত্বভার বহন করিবার জন্য সুদৃঢ় সংকল্প নিয়া, সর্বপ্রথমে প্রস্তুত হইলেন বাংলার একজন হিন্দু সন্তান, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন—বিধান-আচার্য কেশবচন্দ্রের নির্দেশ অনুসারে।’ এই ঘটনার উল্লেখ শেষে মাওলানা আকরম খাঁর মন্তব্য, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
গিরিশচন্দ্রের জন্ম তখনকার ঢাকা জেলা, বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার মহেশ্বরদি পরগনার পাঁচদোনা গ্রামে। নবাব আলিবর্দী খাঁর দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায়ের বংশে তাঁর জন্ম। ফারসি ভাষা চর্চার জন্য এই বংশের সুনাম ছিল। পাঁচ বছর বয়সেই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল। সাত বছর বয়সেই ফারসি ভাষা শিক্ষা আরম্ভ করেন। ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর অনীহা ছিল। ফলে ১৩-১৪ বছর বয়সে তাঁকে মুন্সি কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮-১৯ বছর বয়সে তাঁকে তাঁর এক ভাই ময়মনসিংহে নিয়ে যান এবং ফারসি সাহিত্যে যাতে বুৎপত্তি লাভ করতে পারেন, সে জন্য একজন ভালো মওলানার হাতে তাঁকে তিনি তুলে দেন। সংসদ চরিতাভিধান-এর মতে, এরপর তিনি ময়মনসিংহ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারিতে নকলনবিশের কাজ করতেন। কিন্তু সে কাজ তাঁর ভালো লাগত না। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণের প্রভাবে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন এবং গ্রহণ করেন এই ধর্মের প্রচারকের ব্রত। সর্বধর্মসমন্বয়ে উৎসাহী ভাই গিরিশচন্দ্র কেশবচন্দ্রের আদেশে ইসলাম ধর্ম অনুশীলনে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। আরবি ভাষা ও ইসলাম ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লক্ষ্নৌ যান। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর আত্মজীবনী আত্ম-জীবন-এ লেখেন, ‘মোসলমান জাতির মূল ধর্মশাস্ত্র কোরআন শরীফ পাঠ করিয়া এসলাম ধর্মের গূঢ়তত্ত্ব অবগত হইবার জন্য আমি ১৮৭৬ খৃঃ লক্ষ্নৌ নগরে আরব্যভাষা চর্চা করিতে গিয়াছিলাম।’ তখন তাঁর বয়স ছিল ৪২ বছর। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ‘সুবিজ্ঞ’ বৃদ্ধ মৌলবি এহসান আলী। ‘আরব্য ব্যাকরণ এবং পারস্য দেওয়ান হাফেজের’ চর্চা করতেন তাঁর কাছে। মৌলবি এহসান আলী সাহেব গিরিশচন্দ্রকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এরপর লক্ষ্নৌ থেকে আরবি ব্যাকরণের চর্চা শেষে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানেও তিনি একজন মৌলবির কাছে আরবির পাঠ নিতেন নিয়মিত। পরে ঢাকায় এসে মৌলবি আলিমুদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে আরবের ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ নেন। এ সময়ই গিরিশচন্দ্রের কোরআন শরিফ পাঠের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বলে এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তাঁর পক্ষে সরাসরি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। ফলে তিনি ‘ঢাকা নগরস্থ সমবিশ্বাসী বন্ধু’ মিঞা জালালউদ্দিনের মাধ্যমে একখানা কোরআন সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তাঁর আত্ম-জীবন-এ তিনি এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এরপর আমি তফসির ও অনুবাদের সাহায্যে পড়িতে আরম্ভ করি। যখন আমি তফসিরাদির সাহায্যে আয়াত সকলের প্রকৃত অর্থ কিছু কিছু বুঝিতে পারিলাম, তখন তাহা অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।’
কোরআন শরিফ-এর বাংলায় অনুবাদের কাজটা মূলত শুরু হয় ১৮৮১ সালের শেষভাগ থেকে। গিরিশচন্দ্র তখন ময়মনসিংহ শহরে বসবাস করতেন। অল্প অল্প করে অনুবাদ করে তা খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করতে থাকেন। আত্ম-জীবন-এ এর বিবরণ দিয়ে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়, পরে কলকাতায় আসিয়া খণ্ডশঃ আকারে প্রতিমাসে বিধানযন্ত্রে মুদ্রিত করা যায়। প্রায় দুই বছরে কোরআন সম্পূর্ণ অনুবাদিত ও মুদ্রিত হয়। পরিশেষে সমুদয় এক খণ্ডে বাঁধিয়া লওয়া যায়। প্রথমবারে সহস্র পুস্তক মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহা নিঃশেষিত হইলে পরে ১৮৯৮ সালে কলকাতা দেবযন্ত্রে তাহার দ্বিতীয় সংস্করণ হয়। দ্বিতীয়বারের সহস্র পুস্তকও নিঃশেষিত প্রায়। এখন (১৯০৬ খ্রি.) সংশোধিত আকারে তাহার তৃতীয় সংস্করণের উদ্যোগ হইতেছে।’
অবশ্য একজন ভিন্ন ধর্মমতের ব্যক্তিপুরুষ পবিত্র কোরআন শরিফ অনুবাদ করায় তখনকার মুসলমান সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ যে ক্ষুব্ধ ও ক্রোধান্বিত হয়নি, তা নয়। হয়েছিল। কেশবচন্দ্র তাদের সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে দুঃখ পেয়েছিলেন এবং মুসলমান সমাজের প্রতি তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়বাদের মন্ত্র ও আদর্শের পক্ষে সুদৃঢ় অভিমত তুলে ধরেছিলেন। বাংলায় পবিত্র কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের ঘটনায় তিনি অপরিসীম আনন্দ পেয়েছিলেন।
তবে শিক্ষিত ও উদার স্বাধীনচেতা মুসলমানদের বৃহত্তর অংশ গিরিশচন্দ্র সেনের বাংলা অনুবাদে পবিত্র কোরআন শরিফ পেয়ে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল, এক অর্থে তা অভাবিত ও অভূতপূর্ব। তখনকার কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবি শিক্ষক আহমদউল্লা এবং আরও কিছু আলেম-উলেমা অনুবাদকের উদ্দেশে ইংরেজিতে যে চিঠি লিখেছিলেন, বাংলায় তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলো। তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাসে ও জাতিতে মোসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতাদৃশ চেষ্টা ও কষ্টসহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদিগের অত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়।
‘কোরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণসমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমণ্ডলীর এতাদৃশ উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইলেন, তখন সেই সকল লোকের নিকটে আত্মপরিচয় দিয়া তাহার উপযুক্ত সম্ভ্রমলাভ করা উচিত।’
উল্লেখ করা যেতে পারে, পবিত্র কোরআন শরিফ ভাই গিরিশচন্দ্র অনুবাদ করেছিলেন নিজের নামস্বাক্ষরহীনভাবে। যখন তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেলেন, প্রশংসা পেলেন এবং সেটা স্বয়ং মুসলমান সমাজের কাছ থেকে, তখন তিনি স্বনামে তা প্রকাশ করলেন। এবং এ সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ‘অনুবাদকের বক্তব্যে’ বললেন, ‘আজ কোরআনের অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এতকালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রীমদাচার্য কেশবচন্দ্র সেনের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম; তিনি তাহা পাইয়া পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন ও তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন; শেষাংশ আর তাহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি এই অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিলে তাহার কত না আহ্লাদ হইত, দাসও তাহার কত আশীর্বাদ লাভ করিত।’
এর পর থেকে তিনি মুসলমান ধর্ম বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন ও অনুবাদের পরিধি ক্রমাগত বাড়িয়ে চললেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি আরবি ও ফারসি থেকে হাদিসসহ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), খলিফাবৃন্দ, মুসলমান মনীষীবর্গের জীবনীসহ অন্য বহু বিষয়ে মোট ৪২টি গ্রন্থ বাংলায় রচনা ও প্রকাশ করেন।
এর পর থেকে বাংলার মুসলমান সমাজে যাতে গিরিশচন্দ্রের বাংলায় অনূদিত কোরআন শরিফ বহুল পরিমাণে বিক্রি, প্রচার ও আদৃত হয়, তার জন্যও চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অনেক মুসলমান বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। বাংলা ১২৮৮ সনের ৬ ফাল্গুন আবুয়ল্ মজফ্র আবদুল্লাহ নামের একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি পত্র মারফত অনুবাদককে জানান, ‘মহাশয়ের বাংলা ভাষায় অনুবাদিত কোরআন শরিফ দুই খণ্ড উপহার প্রাপ্ত হইয়া অতি আহ্লাদের সহিত পাঠ করিলাম। এই অনুবাদ আমার বিচেনায় অতি উত্তম ও শুদ্ধরূপে টীকাসহ হইয়াছে। আপনি তফসীর হোসেনী ও শাহ আবদুল কাদেরের তফসীর অবলম্বন করিয়া যে সমস্ত টীকা লিখিয়াছেন এজনের ক্ষুদ্র বিদ্যাবুদ্ধিতে পর্যন্ত বুঝিতে পারিয়াছি, তাহাতে বোধ করি যে, এ পর্যন্ত কোরআন শরীফের অবিকল অনুবাদ অন্য কোনোও ভাষাতেই করা হয় নাই, এবং আমি মনের আহ্লাদের সহিত ব্যক্ত করিতেছি যে, আপনি যে ধর্ম্ম উদ্দেশ্যে যার পর নাই পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এই অনুবাদ করিয়াছেন, ইহার ফল ঈশ্বর আপনাকে ইহ ও পরকালে প্রদান করুন।’
এবং ১৯৩৬ সালে যখন ভাই গিরিশচন্দ্রের কোরআন শরিফ-এর চতুর্থ সংস্করণ কলকাতা থেকে বের হচ্ছে, তার ভূমিকায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ অকপটে লিখেছেন, ‘...তখন আরবি-পারসি ভাষায় সুপণ্ডিত মোছলমানের অভাব বাংলাদেশে ছিল না। তাঁহাদের মধ্যকার কাহারও কাহারও যে বাংলা সাহিত্যের উপরও যথেষ্ট অধিকার ছিল তাঁহাদের রচিত বা অনুবাদিত বিভিন্ন পুস্তক হইতে তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ তাহাদের একজনেরও ঘটিয়া উঠে নাই।’ পরিশেষে অনূদিত এই কোরআন শরিফ সম্পর্কে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় মন্তব্য, ‘গিরিশচন্দ্রের এই অসাধারণ সাধনা ও অনুপম সিদ্ধিকে জগতের অষ্টম আশ্চর্য বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে।’
মহীয়সী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনও (১৮৮০-১৯৩২) যারপরনাই খুশি হন বাংলায় পবিত্র কোরআন শরিফ-এর অনুবাদে। গিরিশচন্দ্রকে তিনি ‘মোসলমান ব্রাহ্ম’ বলে উল্লেখ করেছেন নিঃসংকোচে। গিরিশচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁহার (রোকেয়ার) সঙ্গে আমার মাতৃপুত্র সম্বন্ধ স্থাপিত। সেই মনস্বিনী মহিলা উক্ত ঘনিষ্ঠতার পরিচয় নিজেই প্রদান করিয়া থাকেন। তিনি আমাকে পত্রাদি লিখিতে পত্রে নিজের নাম না লিখিয়া নামের পরিবর্তে “মা”, “আপনার স্নেহের মা” বলিয়া স্বাক্ষর করিয়া থাকেন।’
বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ এবং মুসলমান মনীষী ও তাঁদের অন্যান্য সাহিত্যকর্ম অনুবাদের কল্যাণে তিনি বাংলার মুসলমান সমাজে এতদূর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে, তাঁকে ‘মৌলবি’ ও ‘ভাই’ গিরিশচন্দ্র অভিধায় অভিহিত করা হতো। সে সময়কার মুসলমান সমাজের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে তাঁর জীবনীও ছাপা হয়েছে সবিস্তারে। এমন কী তাঁর মৃত্যুর পর শবানুগমন করেছিলেন ব্রাহ্ম ও মুসলমান সমাজের লোকজন সমভাবে।
গিরিশচন্দ্র সেনকে আমরা ‘মৌলবি’ কিংবা ‘ভাই’, যে বিশেষণেই বিশেষায়িত করি না কেন, বাংলার ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হিন্দু ও মুসলমান—এই দুই বৃহৎ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়গত সেতুবন্ধনে যে সবিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তাঁর বাংলায় অনূদিত পবিত্র কোরআন শরিফ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কোরআন শরিফ-এর সেই অনুবাদ-কর্মের কাল সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে খুবই নীরবে। কেউ কিছু লেখেননি। আমরা কি জাতি হিসেবে এতই কৃপণ, অনুদার এতটাই! prothom-alo
সবটুকু একত্রে পড়ুন "বাংলায় প্রথম কোরআন শরিফ"

পবিত্র কুরআন শরীফ এর প্রথম বাংলা অনুবাদ


http://www.rongmohol.com/extensions/pic_man/img/upload/4724Girish_chandra_sen.JPG
গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪ বাংলা ১২৪১ - ১৯১০)। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নামে তিনি অধিক পরিচিত। তাঁর প্রধান পরিচয় ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন- এর প্রথম বাংলা অনুবাদক হিসেবে। তখন প্রায় ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, মূলভাষা থেকে অনূদিত হলে গ্রন্থটির পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবে। পবিত্র কুরআন সম্পর্কেও এমন ধারণা ছিল। এ কারণে অনেক মুসলিম মনীষী এর বঙ্গানুবাদ করতে সাহস পাননি। গিরিশচন্দ্র সেনই অন্য ধর্মালম্বী হয়েও এই ভয়কে প্রথম জয় করেন। শুধু কুরআন শরীফের অনুবাদ নয় তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক গবেষণাও করেন।
জন্ম ও বংশপরিচয়
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে এক বিখ্যাত দেওয়ান বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন।[১] গিরিশচন্দ্রের পিতা ছিলেন মাধবরাম সেন এবং পিতামহ ছিলেন রামমোহন সেন। গিরিশচন্দ্ররা ছিলেন তিন ভাই। ঈশ্বরচন্দ্র সেন, হরচন্দ্র সেন এবং সর্বকনিষ্ঠ গিরিশচন্দ্র সেন। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের পরিবার ছিল অত্যন্ত গোঁড়াপন্থি। পরিবারে সনাতন ধর্মের আচরণ প্রয়োজনের তুলনায় একটু বাড়াবাড়ি রকমভাবেই মেনে চলা হতো। এমন একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারে জন্ম নিয়েও গিরিশচন্দ্র সেন একজন সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত মানুষ হয়েছিলেন। অন্য ধর্মের উপর গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
বাল্যকাল ও আরবি শিক্ষা
প্রাথমিক পড়া শেষ করে গিরিশচন্দ্র ঢাকার পোগোজ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি বেশিদিন বিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা হয়নি। তাঁর বিদ্যালয় ছাড়ার কারণ নিয়ে একটি ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। একদিন তিনি শ্রেণীকক্ষে দেখলেন শিক্ষক তাঁর এক সহপাঠীকে পড়া না পারার জন্য খুব মারছেন। এই দেখে তাঁর মনেও ভয় ধরে গেল, শিক্ষক যদি তাঁকেও মারেন। এই ভয়ে তিনি বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে বাসায় চলে এলেন। তাঁর বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার এখানেই সমাপ্তি। এরপর তিনি পাঁচদোনায় নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তার পাশের গ্রাম শানখোলায় কৃষ্ণ চন্দ্র রায় নামে একজন খুব ভালো ফারসি জানা লোকের কাছে গিরিশচন্দ্র ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করেন।[১] বছর দুয়েকের মধ্যে ফারসি ভাষা তিনি বেশ ভালো ভাবেই আয়ত্ব করে ফেলেন। গিরিশচন্দ্র ময়মসিংহের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কাজী মৌলবী আব্দুল করিম সাহেবের কাছে রোক্কাতে আল্লামী অধ্যয়ন করেন।
১৮৭৬ সালের আরবি শিক্ষার জন্য গিরিশ চন্দ্র লক্ষ্মৌ যান। লক্ষ্মৌ ব্রাহ্ম সমাজের আনুকূল্যে এবং সহযোগিতায় জ্ঞানবৃদ্ধ মৌলবী এহসান আলী সাহেবের কাছে আরবি ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজের পাঠ গ্রহণ করেন। লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতায় ফিরে একজন মৌলবীর কাছে এ বিষয়ে আরও কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকায় নলগোলায় মৌলবী আলিমউদ্দিন সাহেবের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন।[১]
কর্মজীবনে প্রবেশ
বেশ কিছুদিন বেকার বসে থাকার পর তিনি তাঁর মেজভাইয়ের সাথে চাকরির খোঁজে ময়মনসিংহ গমন করেন। সেখানে তিনি ময়মনসিংহ জেলাস্কুলে সহকারী শিক্ষকের (দ্বিতীয় পন্ডিত) পদে যোগদান করেন। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সামান্য এক চাকরির মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে পারলেন না। তাঁর ছিল জ্ঞানের পিপাসা। তিনি নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাও শুরু করলেন গিরিশচন্দ্র। তৎকালীন ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'ঢাকা প্রকাশ' পত্রিকায় তিনি ময়মনসিংহের সংবাদদাতা ছিলেন। তাছাড়া এই পত্রিকায় তাঁর অনেকগুলো লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল।
ব্রাহ্ম ধর্মের দীক্ষালাভ
চাকরি ছেড়ে দিয়ে গিরিশচন্দ্র কলকাতায় গমন করেন। কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁর সাথে দেখা হয় রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের তৎকালীন প্রচারক কেশবচন্দ্র সেনের। সে সময় কেশবচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের নববিধান শাখার প্রধান। তাঁরই প্রভাবে গিরিশচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভাই উপাধিতে ভূষিত করে।
কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক
কেশবচন্দ্রের অনুরোধ ও ব্যবস্থাপনাতে তিনি ফারসি ভাষায় আরো গভীর জ্ঞান লাভ এবং আরবি-ফারসি সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করার জন্য কানপুর ও লখনউ গমন করেন। ফিরে আসার পর কেশবচন্দ্রের উৎসাহেই তিনি ইসলামি দর্শনের উপর গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য প্রধান বাঁধাই ছিল ভাষা। হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহ অনেক আগেই বাংলায় অনূদিত হয়েছিল, কিন্তু ইসলাম ধর্মের কোন ধর্মশাস্ত্রই বাংলাভাষায় ছিলনা। বিশেষ করে পবিত্র কুরআন ও হাদিস তখনো বাংলায় প্রকাশিত হয়নি। যার ফলে কুরআনের মর্মার্থ অনুবাধন করা থেকে বৃহত্তর মুসলিম গোষ্ঠী পুরোপুরিই বঞ্চিত ছিল। তাই ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত নববিধান সভা ইসলাম ধর্মগ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই, আরবি-ফারসি ভাষার সুপন্ডিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।
লেখক গিরিশচন্দ্র সেন
তিনি কুরআন শরীফের সম্পূর্ণ অংশ, মিশকাত শরীফের প্রায় অধিকাংশ, হাদিস, তাজকিরাতুল আউলিয়া, দিওয়ান-ই-হাফিজ, গুলিস্তাঁ, বুঁস্তা, মকতুব্বত-ই-মাকদুস, শারফ উদ্দিন মুনিবী, মসনভী-ই-রুমী, কিমিয়া-ই-সাদত, গুলশান-ই-আসরার ইত্যাদিসহ বহু ইসলামি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন।
কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ
[justify]অনুবাদক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি কুরআনের অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে মোট ১২ টি খন্ডে এই অনুবাদক্ররম সমাপ্ত করেন। 'তাপসমালা'র দুটো খন্ড বের হওয়ার পর ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কুরআনের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খন্ড প্রকাশের সময় গিরিশচন্দ্র অনুবাদকের নাম গোপন রাখেন। কারণ তৎকালীন সময়ে কাজটি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মুসলিম সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিলনা। গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র প্রকাশক গিরিশচন্দ্র সেন এবং মুদ্রক তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিল। ৩২ পৃষ্ঠার এই খন্ডের মূল্য ছিল মাত্র চারআনা। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের আশংকা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। মুসলমান আলেমসমাজ এই মহৎকর্ম সম্পাদন করার জন্য এই অজ্ঞাতনামা অনুবাদকের প্রশংসা করে ব্রাহ্মসমাজের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তাঁদের প্রশংসাপূর্ণ পত্রের অংশবিশেষ নিন্মে তুলে ধরা হলোঃ
“    
আমরা বিশ্বাস ও জাতিতে মুসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতোদৃশ চেষ্টা ও কষ্ট সহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদের আত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়। 

“    
কুরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণ সমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমন্ডলীয় এতোদৃশ্য উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইবেন, তখন সেই সকল লোকের নিকট আত্ন-পরিচয় দিয়া তাঁহার উপযুক্ত সম্ভ্রম করা উচিত।

কুরআন অনুবাদ শেষ করে ভাই গিরিশচন্দ্র্র সেন বলেছিলেনঃ
“    
আজ কুরআনের সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এত কালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রী মদাচার্য্য কেশবচন্দ্রের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম। তিনি তাহাতে পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন এবং তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। শেষাংশ আর তাঁহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাঁহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া তাঁহার কত না আহ্লাদ হইত, এছাড়াও তাঁহার কত আশীর্ব্বাদ লাভ করিত।

কুরআনের সম্পূর্ণ খন্ড একত্রে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে। সম্পূর্ণ খন্ডেই প্রথম তিনি স্বনামে আত্নপ্রকাশ করেন। ভাই গিরিশ্চন্দ্র সেন অনূদিত কুরআনের চতুর্থ সংস্করণে মৌলানা আকরাম খাঁ একটি প্রশংসাসূচক ভূমিকা লিখেছিলেন। 
হাদিসের অনুবাদ
কুরআনের পর তাঁর আর একটি বড় কাজ হাদিসের অনুবাদ। হাদিসও কয়েকখন্ড পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম খন্ড হাদিস-পূর্ব-বিভাগ (১ম খন্ড) প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি। শেষ খন্ড হাদিস-উত্তর-বিভাগ (৪র্থ খন্ড) প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।
মৃত্যু
মুক্তমনা ও অসাধারণ মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।


তথ্যসুত্র : বাংলা উইকি
সবটুকু একত্রে পড়ুন "পবিত্র কুরআন শরীফ এর প্রথম বাংলা অনুবাদ"
Posted in by Akashnill. No Comments