যুলুম বা অত্যাচার করা – ১ম পর্ব


কবীরা গুনাহ- অধ্যায় ২৭
ইমাম আয যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ)


যুলুম বা অত্যাচার বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে অধিক প্রচলিত রূপ হচ্ছে
মানুষের সম্পদ হরণ,
জোর পূর্বক অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া,
মানুষকে প্রহার করা,
গালিগালাজ করা,
বিনা উস্কানীতে কারো উপর আক্রমণ
এবং আর্থিক, দৈহিক ও মর্যাদার ক্ষতিসাধন
এবং দুর্বলদের উপর নৃশংসতা চালানো ইত্যাদি।
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সূরা ইবরাহীমে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“যালিমদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহকে কখনো উদাসীন মনে করো না। আল্লাহ এদেরকে শুধু একটি সুনির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত বিলম্বিত করেন,
যেদিন চক্ষুসমূহ বিস্ফোরিত হবে,
তারা মাথা নিচু করে উঠিপড়ি করে দৌড়াতে থাকবে,
তাদের চোখ তাদের নিজেদের দিকে ফিরবে না
এবং তাদের হৃদয়সমূহ দিশাহারা হয়ে যাবে।

মানুষকে আযাব সমাগত হওয়ার দিন সম্পর্কে সাবধান করে দাও।
সেদিন যুলুমবাজরা বলবে; হে আমাদের প্রভূ ! অল্প কিছুদিন আমাদেরকে সময় দিন,
তাহলে আমরা আপনার দাওয়াত কবুল করে রাসূলদের অনুসরণ করব।
তোমরা কি ইতিপূর্বে কসম খেয়ে খেয়ে বলতে না যে তোমাদের পতন নেই?

যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছে, তোমরা তো তাদের বাসস্থানে বাস করেছ
এবং সেসব যালেমের সাথে আমি কেমন আচরণ করেছি,
তা তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।
উপরন্তু আমি তোমাদের জন্য অনেক উদাহরণ দিয়েছি।” (সূরা ইবরাহীম ৪২-৪৫)

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরো বলেন, “শুধু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে।” (সূরা আশ শুয়ারা ৪২)
সূরা আশ শুরার শেষ আয়াতে তিনি বলেছেন,”যুলুমবাজরা তাদের যুলুমের পরিণতি সহসাই জানতে পারবে।” (সূরা আশ শুয়ারা ২২৭)
এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “আল্লাহ যালেমকে সুদীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না।” (বুখারী, মুসলিম) এরপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন,”তোমার প্রভূর পাকড়াও এ রকম হয়ে থাকে, যখন তিনি যুলুমরত জনপদসমূহকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।” (সূরা হুদ ১০২)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “কেউ যদি তার কোন ভাইয়ের সম্মানহানি কিংবা কোন বস্তুর ক্ষতিসাধন করে থাকে, তাহলে আজ তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেয়া উচিত অর্থাৎ ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত এবং সে ভয়াবহ দিন আসার আগে এটা করা উচিত, যেদিন অর্থ দিয়ে কোন প্রতিকার করা যাবে না, বরং তার কাছে কোন নেক আমল থাকলে তার যুলুমের পরিমাণ হিসেবে মযলুমকে উক্ত নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে এবং তার কোন অসৎ কাজ না থাকলেও উক্ত মযলুমের অসৎ কাজ তার ওপর বর্তানো হবে।” (বুখারী ও তিরমিযি)
আর একটি হাদীসে কুদসীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেছেনঃ “হে আমার বান্দারা ! আমি নিজের ওপর যুলুম হারাম করে দিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের ওপর যুলুম করা থেকে বিরত থাক।” (মুসলিম, তিরমিযি)
অন্য এক হাদীসে উল্লেখ রয়েছে; “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমরা কি জান, দরিদ্র কে? তাঁরা বললেন, আমাদের মধ্যে যার অর্থ সম্পদ নেই, সে দরিদ্র। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন; আমার উম্মতের মধ্যে দরিদ্র ব্যক্তি সে, যে কিয়ামতের দিন প্রচুর নামায, যাকাত, রোযা ও হজ্জ্ব সাথে করে আনবে, কিন্তু সে এমন অবস্থায় আসবে,
কাউকে গালি দিয়ে এসেছে,
কারো সম্পদ হরণ করে এসেছে,
কারো সম্মান হানি করেছে,
কাউকে প্রহার করেছে,
কারো রক্তপাত করেছে। এরপর এ ব্যক্তির সৎ কর্মগুলো তাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। এভাবে মযলুমদের ক্ষতি পূরণের সাথে তার সৎ কাজগুলো শেষ হয়ে গেলে মযলুমদের গুনাহগুলো একে একে তার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (বুখারী)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণও অন্যের জমি জবর দখল করবে, কিয়ামতের দিন তার ঘাড়ে সাতটি পৃথিবী চাপিয়ে দেয়া হবে।” ( বুখারী ও মুসলিম)
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেনঃ “আমি সে ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হই, যে এমন ব্যক্তির উপর অত্যাচার করে, যার আমি ব্যতীত কোন সাহায্যকারী নেই।”
তাওরাতে বর্ণিত রয়েছে যে, ” কিয়ামতের দিন পুলসিরাতের পাশ থেকে একজন এ বলে ঘোষণা দিতে থাকবেঃ “ওরে বলদর্পী, নিষ্ঠুর যালেমগণ! আল্লাহ নিজের মর্যাদা ও প্রতাপের শপথ করে বলেছেন, আজকের দিন কোন অত্যাচারী এ পুল পার হয়ে জান্নাতে যেতে পারবে না।”
হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “মক্কা বিজয়ের বছর যখন আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুহাজিরগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রত্যাবর্তন করেছিল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ “তোমরা কি আমাকে আবিসিনিয়ায় থাকাকালীন কোন বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা জানাবে? তখন মুহাজিরদের মধ্য থেকে এক যুবক বলল; ‘জ্বী -হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! একদিন আমরা সেখানে বসা থাকা অবস্থা দেখলাম, আমাদের পাশ দিয়ে এক বৃদ্ধা মাথায় এক কলসী পানি নিয়ে যাচ্ছে। সহসা এক যুবক এসে তার ঘাড়ে হাত দিয়ে জোরে ঠেলা দিলে তাতে বৃদ্ধা পড়ে গেল এবং তার পানির কলসীও পড়ে ভেঙ্গে গেল। বৃদ্ধা উঠে দাঁড়িয়ে সে যুবকটির দিকে তাকিয়ে বলল, “হে বিশ্বাসঘাতক ! আল্লাহ যেদিন আরশ স্থাপন করবেন, যেদিন আগের ও পরের সকল মানুষকে সমবেত করবেন, এবং যেদিন মানুষের হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবে, সেদিন তুই দেখে নিস, আল্লাহর সামনে তোর কি পরিণতি হয় এবং আমার কি অবস্থা হয়।” একথা শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “বৃদ্ধা ঠিক বলেছে। যে জাতি তার দুর্বলদের কল্যাণার্থে সবলদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে না, সে জাতিকে আল্লাহ কিভাবে সম্মানিত করবেন?” (ইবনে মাজাহ, ইবনে হাববান ও বায়হাকী)
Leave a Comment