ইসলামের ইতিহাস বিকৃতি ও ইসলামী ধর্ম বাণিজ্য

কাউসার ইকবাল


ধর্ম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাতারা বিভিন্ন কৌশলে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি করলেও তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের ‘আত্মিক’ তথা নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশনা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। মানুষের আত্মিক তথা নৈতিক উন্নতি ঘটিয়ে মানবসমাজ তথা বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যেই মূলতঃ ধর্ম প্রতিষ্ঠাতারা ধর্ম সম্প্রদায় সৃষ্টি ও বিকাশের প্রয়াস পেয়েছিলেন। ধর্মকে ‘বাণিজ্যিক’ বিষয়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধর্ম সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। কিন্তু যুগের পরিক্রমায় মানুষেরা ধর্মকে ‘বাণিজ্যিক’ বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছেন। পুণ্যের ও স্বর্গ বা বেহেস্তের লোভ দেখিয়ে মন্দির-মসজিদ নির্মাণের নামে শরিয়তপন্থিরা, মুরিদ বা অনুসারী বাড়ানোর নামে তরিকতপন্থিরা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল করার নামে রাজনীতিকরা ধর্মভীরুদের কাছ থেকে টাকা আহরণের কৌশল অবলম্বন করে চলেছেন। ‘আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে পয়সা বা অর্থ না নেয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে পয়সা বা অর্থ আয়ের ব্যবস্থাস্বরূপ ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ নামে এক শিক্ষা-ব্যবস্থাও গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, হজ্ব-কোরবানি নিয়ে বাণিজ্য, মাজার বানিয়ে ওরশ করার নামে বাণিজ্য, পুজা-পার্বণ, ঈদ-রোজা, তাবলীগ জামায়াতের এস্তেমা, বড়দিন ইত্যাদি উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য ও যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানাভাবে মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায়ের প্রবণতাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার ধর্মকে ব্যবহার করে বড় বড় দেশগুলোর অস্ত্র ব্যবসায়ীদের ‘অস্ত্র বাণিজ্য’ও চলছে পুরোদমে। পাশাপাশি ধর্মীয় সম্পদায়ের মানুষের প্রিয় শব্দ দ্বারা ব্যাংক-বীমা জাতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেও মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে মানুষকে ঠকানোর বা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আয় করা লোকের সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নয়। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ধর্মভীরু মানুষের কাছ থেকে টাকা আহরণের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই যেন ধর্ম-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাকারীরা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে গেছেন। এতে করে মানুষকে শান্তিবাদী, নীতিবান ও আদর্শবান করে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যে প্রয়াস নিয়ে ধর্ম-সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠাকারীরা ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই উদ্দেশ্য বর্তমানে খুব কমই পূরণ হচ্ছে। পক্ষান্তরে যারা ‘বাণিজ্যিক’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ধর্মকর্ম করছে, তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ কমে গিয়ে এমন এক উগ্রতাবোধের জন্ম হয়েছে যে, কেউ তাদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সমালোচনা করলে তারা ‘বন্য মহিষের’ রূপ ধরে ‘বুনো শিং’ নিয়ে তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে, পাছে তাদের ধর্ম নিয়ে বাণিজ্যের পথ না বন্ধ হয়ে যায়Ñ সেই আশঙ্কায়। ধর্ম নিয়ে ‘বাণিজ্যের পথ’ বন্ধ হবার আশঙ্কা না থাকলে কেউ কারো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সমালোচনা করলে তাতে কারো কোনো অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়। কিন্তু ধর্মকে বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে যুগে যুগে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে। ইসলাম ধর্মও এই প্রচেষ্টার বাইরে থাকেনি।
ইসলাম ধর্মে মতভেদের কারণে শিয়া ও সুন্নী দুইটি প্রধান দলে বিভক্ত মুসলিমরা। এই মতভেদের ইতিহাসটা কি তা অনেকেরই অজানা, বিশেষ করে সুন্নী দলভুক্তদের কাছে। আর শিয়া দলভুক্তরা যা জানে, তা যদি সত্য হয়Ñ তবে বলতে হয়Ñ রাসুল মোহাম্মদের (সাঃ) ওফাতের পর তাঁর শরীর মাটির নিচে ঢোকার আগেই ইসলাম ধর্ম কবরস্থ হয়ে গেছে।
ঢাকার ২৬ বাংলাবাজারস্থ র‌্যামন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশ্তী রচিত ‘মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ’ বইটি পড়ে মতভেদের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে এ রকমÑ
বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে ১৮ জিলহজ্ব তারিখে ‘গাদিরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে হজরত আলী (আঃ)কে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য পূর্বেই রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) কে প্রদত্ত এক নির্দেশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে “হে রাসুল, আপনার রব হইতে যাহা নাজেল করা হইয়াছে তাহা পৌঁছাইয়া দিন। আর যদি তাহা না করেন, তাহা হইলে তাঁহার (আল্লাহর) রেসালত পৌঁছাইয়া দেওয়া হইল না। আল্লাহ আপনাকে মানবমণ্ডলী হইতে লইয়া আসিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের দলকে হেদায়েত করেন না” (৫ঃ৬৭) কোরআনের সব শেষের আগের এই আয়াতটি নাজেল করিয়াছিলেন। এই আয়াত নাজেল হবার পর রাসুল (সাঃ) সেখানেই থামিয়া গেলেন এবং বাহন হইতে নামিয়া গেলেন। কাফেলার অগ্রবর্তী এবং পশ্চাদবর্তী সকলকে একত্র করিয়া সেখানেই আলী (আঃ) এর অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদন করার ব্যবস্থা করিলেন (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৩)। উটের উপরে বসার কয়েকটি আসন একর পর এক স্থাপন করে মিম্বার তৈরি করা হলো। তার ওপর উঠে রাসুল (সাঃ) জনতার কাছে অবতীর্ণ বাণী পেশ করলেন এবং বললেনÑ আমি কি তোমাদের আপন জীবন হতে অধিক প্রিয় নই? উত্তরে লোকেরা বললÑ হাঁ হাঁ ইয়া রাসুলুল্লাহ। জনগণ হতে এই স্বীকৃতি লাভের পর তিনি আলী (আঃ) এর দুই বাহু ধরিয়া জনতার সম্মুখে তাঁকে শূন্যে তুলে ধরলেন এবং বললেনÑ “আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ, তুমি তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর যে তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাকে শক্রুরূপে গ্রহণ কর যে তার সঙ্গে শক্রুতা করে এবং সাহায্য কর তাকে যে সাহায্য করে এবং লাঞ্ছনা দাও তাকে যে লাঞ্ছনা দেয়।” তখন হজরত ওমর (রাঃ) সহ উপস্থিত সকলেই নবনিযুক্ত নেতার কাছে গিয়ে বায়াত গ্রহণ করেন। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৪)
হজরত আলী (আঃ) এর নিকট উপস্থিতদের বায়াত গ্রহণের অনুষ্ঠানপর্ব শেষ হলে তখন নাজেল হয় কোরআনের শেষ আয়াত যার বঙ্গানুবাদ হচ্ছেÑ ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ (৫ঃ৪)। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১৪)
ওপরোক্ত বর্ণনা অনুুযায়ী এটা পরিষ্কার যে, রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের পর ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব হজরত আলী (আঃ) এর ওপরই অর্পিত হয়েছিল। কিন্তু রাসুল মোহাম্মদ (সাঃ) এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই হজরত আবু বকর (রাঃ), হজরত ওমর (রাঃ), হজরত ওসমান (রাঃ) সহ অনেক সাহাবী (যারা মূলত উমাইয়া বংশীয়) হজরত আলী (আঃ) এর বিপক্ষে অবস্থান নিলেন। এ প্রসঙ্গে ওপরোক্ত বইয়ের ১২১-১২২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছেÑ “সেদিন [রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের দিন] মদিনায় গোলযোগের সৃষ্টি হইল। মাওলার বিরোধী দল মদিনা ত্যাগ করিয়া বনি সাকিফায় চলিয়া গেল এবং সেখানে উপস্থিত লোকজনেরা মিলিয়া একপ্রকার নির্বাচন করিয়া আবু বকরকে খলিফা নিয়োগ করিল। এই নির্বাচনের মধ্যে কিছু সংখ্যক আনসারও অংশগ্রহণ করিয়াছিল। নির্বাচন একেবারে নির্বিবাদে সম্পন্ন হয় নাই। কারণ এই নির্বাচন সম্পন্ন করিতে দীর্ঘ তিন দিন অতিবাহিত হইয়াছিল। যাহা হোক, রাসুলের দেহত্যাগের তৃতীয় দিবসে আবু বকর খলিফা নির্বাচিত হইয়া দলবল লইয়া মদিনায় ফিরিতেছেন।
এদিকে হাসেমীগণ এবং মদিনার আনসারগণ নবীর বিয়োগে শোক-সন্তপ্ত অবস্থায় অভিভূত হইয়া পড়েন এবং তৃতীয় দিবসে আলীর নেতৃত্বে রাসুলুল্লাহর কাফন দাফন সম্পন্ন করেন। নির্বাচিত খলিফা তাহার দলবল লইয়া মদিনা প্রবেশের পূর্বেই জানিতে পারিলেন যে, রাসুলুল্লাহর দাফন ক্রিয়া সম্পন্ন করা হইয়া গিয়াছে। তাহারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন কবর হইতে উঠাইয়া রাসুলুল্লাহর দেহ পুনরায় তাহারা তাহাদের ইচ্ছামত দাফন করিবেন। ইহার উদ্দেশ্য অন্য কিছুই নহে। নেতার দাফনক্রিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রনৈতিক অধিকার এবং সর্বপ্রকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ভাব নিহিত থাকে। তাহাদের এইরূপ সিদ্ধান্তের কথা জানিতে পারিয়া আলী তাঁহার জুলফিকার লইয়া মাটির কবরের উপর বসিয়া পড়িলেন তাহাদিগকে এই কাজে বাধা দেওয়ার জন্য। তাহারা নিকটে আসিয়া একে অন্যের মুখ চাহিতে লাগিল। তখন ওমর আবু বকরকে লক্ষ করিয়া বলিলেন: ‘আপনি আমাদের নির্বাচিত খলিফা, হুকুম করুন, আমরা আলীকে আক্রমণ করি।’ আবু বকর খানিক চিন্তা করিয়া বলিলেন: আমি রাসুলুল্লাহকে বলিতে শুনিয়াছিঃ ‘এমন সময় আসিবে যখন আলী মাটির ঘোড়ায় সওয়ার হইবেন তখন যে-ই তাহার মোকাবিলা করিবে সে কাফের হইয়া মারা যাইবে।’ আমার মনে হয় ইহাই সেই মাটির ঘোড়া। এইরূপে তাহারা তাহাদের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করিল।” (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ১২১-১২২)
ওপরোক্ত গ্রন্থের ৮৩ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেÑ “রাসুলের এন্তেকালের প্রায় ২১ বৎসর পরে খেলাফত কোরানের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা সংকলন করেন। এত বিলম্ব করিয়া প্রকাশ করার অন্যতম প্রধান একটি কারণ ছিল মাওলাইয়াতের বিরুদ্ধে এবং আহলে রাসুলের বিরুদ্ধে তাহাদের এই প্রকাশনাকে সাজাইয়া লওয়া। কি বাদ দিতে হইবে এবং কেমন করিয়া সাজাইতে হইবে ইত্যাদি নানারূপ বিষয় ছিল তাহাদের চিন্তার বিষয়। ক্ষমতা ও পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া উপযুক্তভাবে উহার প্রকাশ পরিচালনা করাÑ যাহাতে জনমতে কোনরূপ বিদ্রোহ প্রকাশ না পায়। এত সাবধানতা সত্ত্বেও দেখা গেল কোরান সংকলন হজরত ওসমানের পতনের সর্বপ্রধান কারণ হইয়া দাঁড়াইল।” (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ৮৩)
ওপরোক্ত গ্রন্থের ৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছেÑ “ইমাম বাকের (আঃ) বলিয়াছেন, তিন শতের উপর কোরানের বাক্য ‘তাহরীফ’ অর্থাৎ ‘বদল’ করা হইয়াছে যাহা আহলে বাইতের শানে ছিল।” বদলকৃত বাক্যের কিছু নমুনাও বইটিতে তুলে ধরা হয়।
বইটির ৬ষ্ঠ পৃষ্ঠায় এ রকম একটি নমুনা দেয়া হয় যাতে কোরানের সর্বশেষ আয়াতটিকে খেলাফত সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানে যে বসিয়েছে, তা সহজেই বোধগম্য হয়। কোরানের ৫ নম্বর সুরার ৪ নম্বর আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছেÑ “তোমাদের জন্য (খাদ্য হিসাবে) হারাম করা হইয়াছে শব এবং রক্ত এবং শুকরের মাংস এবং যাহা আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে উৎসর্গিত হইয়াছে এবং গলা চাপিয়া মারা (জন্তু) এবং প্রহারে মৃত (জন্তু) শৃংগাঘাতে মৃত (জন্তু) এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া (জন্তু)Ñ তবে জবেহ দ্বারা যাহা পবিত্র করিয়াছ তাহা ব্যতীত এবং যাহা (মূর্তি পূজার) বেদীর উপর জবাই দেওয়া হয় এবং জুয়ার তীর দ্বারা অংশ নির্ণয়কৃত মাংস। এই সবই ফাসেকী।” এরপর কোরানের সর্বশেষ অবতীর্ণ বাক্যটি এখানে সংযোজিত করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছেÑ ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ এরপর আবার খাদ্য সংক্রান্ত বাক্য “সুতরাং যে ব্যক্তি পাপের দিকে ঝুঁকিয়া নয়, ক্ষুধায় কাতরÑ তাহা হইলে নিশ্চয় আল্লাহ (তাহার প্রতি) ক্ষমাশীল রহিম।”(৫ঃ৪)
কোরআনের শেষ অবতীর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ এই অহি বাক্যটি যাহা গাদিরে খুমে অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা এমন জায়গায় স্থাপন করা হইয়াছে যাহাতে ইহাই বোঝা যায় যে, কেবলমাত্র খাদ্যের ভাল মন্দ (এই আয়াতের নির্দেশমতে) বিচার করিয়া খাইলেই ধর্ম পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। এই আয়াতটি হইল খাদ্য বাছাই করা বিষয়ে একটি সাধারণ ব্যবস্থা। অথচ মধ্যবর্তী কথাটি ইহাতে স্থাপন করাতে মনে হয় দেখিয়া শুনিয়া খানা খাইলেই দ্বীন কামেল হইয়া যায় অর্থাৎ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হইয়া যায়। (প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা ৬-৭)
ওপরোক্ত গ্রন্থের ৬-৭ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত ওপরোক্ত যুক্তিই এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, হজরত আলীকে রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর মদিনার রাষ্ট্রভার গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা অপর খলিফারা এ সংক্রান্ত কোরানের অপর আয়াতগুলি বাদ দিয়ে ‘আজ কাফেরগণ তোমাদের দ্বীন হইতে নিরাশ হইয়া গিয়াছে। অতএব তাহাদিগকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতের পরিপূর্ণতা দান করিলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হইলাম।’ এই বাক্যটিকে কোথায় বসাবে সেই দিশা না পেয়ে হালাল খাবার সংক্রান্ত আয়াতসমূহের ভেতরেই ওপরোক্ত এই আয়াত ঢুকিয়ে দিয়েছে।
ওপরোক্ত গ্রন্থটিতে ইসলামের প্রধান দুটি দল শিয়া ও সুন্নীর মধ্যে বিভেদের বিষয়ে যে ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটিও এসে যায় যে, ইঞ্জিল শরীফ বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে তা যদি আর মানুষের জন্য অনুসরণযোগ্য গ্রন্থ না থাকে, তবে ক্ষমতালাভ ও ভোগের স্বার্থে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা কোরানের যে বিকৃতি ঘটিয়েছে (ঢাকার ২৬ বাংলাবাজারস্থ র‌্যামন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত সদর উদ্দিন আহ্মদ চিশ্তী রচিত ‘মাওলার অভিষেক ও মতভেদের কারণ’ গ্রন্থের ওপরোক্ত বক্তব্য মতে) অন্যকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে, সেই বিকৃত কোরান কি মানুষের জন্য আর গ্রহণযোগ্য থাকে? তা-ও কি ইঞ্জিল শরীফের মতো বাতিলযোগ্য গ্রন্থ হয়ে যায় না? আর কোরান বাতিলযোগ্য গ্রন্থ হলে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের কোরান নিয়ে ধর্ম বাণিজ্যের কোন সুযোগ কি থাকে? আর কোরান যেহেতু বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যেই বিভেদের বড় কারণ এবং এই বিভেদে মসজিদে বোমা হামলা ঘটে মানুষের প্রাণহানি ঘটছে অহরহ, তাই তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ধর্মবাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে রচিত মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী এই গ্রন্থ দিয়ে কোন মুসলিম যেন রাজনীতি করতে না পারে, সেদিকে মুসলিমদেরই সতর্ক থাকতে হবে বেশি।
উৎস:
Leave a Comment