কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা-১


কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা-Download pdf(1015.9kb)

আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সম্পাদনা : ইকবাল হোছাইন মাছুম
যার নিখুত সৃষ্টি কুশলতায় অস্তিত্ব লাভ করেছে এ বিশ্ব জাহান। যার অসীম কুদরতের অনুপম নিদর্শন চাঁদ-সুরুজ ও সিতারা-আসমান। যার করুণা স্নিগ্ধ লালন-প্রতিপালনে ধন্য সকল জড় উদ্ভিদ প্রাণ। সেই মহান রাব্বুল আলামীনের জন্যই আমার সকাল-সন্ধ্যার হামদ-সানা, আমার দিবস রজনীর স্তুতি-বন্দনা।
যার শুভাগমনে আঁধার ঘুচে মানবতার পূর্ব দিগন্তে এক নতুন সূর্যের উদয় হল। মানবতার মুক্তির জন্য মানুষেরই হাতে তায়েফের মাটি যার রক্তে রঞ্জিত হল; সেই নবী রাহমাতুল্লিল আলামীনের প্রতি আমার বিরহী আত্মার সালাত ও সালাম। মদীনা স্বপ্নে বিভোর আমার হৃদয়ের প্রেম-পয়গাম।

মানুষ স্বপ্ন দেখে। ভাল স্বপ্ন দেখে, বলে সুন্দর স্বপ্ন দেখেছি। দেখে খারাপ স্বপ্ন, বলে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখেছি। আবার কখনো বলে একটি বাজে স্বপ্ন দেখেছি।
আসলে স্বপ্ন কি? এ নিয়ে গবেষণা কম হয়নি, মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। কেউ বলেছেন, এটা একটি মানসিক চাপ থেকে আসে। কেউ বলেছেন, শারীরিক বিভিন্ন ভারসাম্যের ব্যাঘাত ঘটলে এটা দেখা যায়, সে অনুযায়ী। কেউ বলেছেন, সারাদিন মনে যা কল্পনা করে তার প্রভাবে রাতে স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন আধুনিক মনোবিজ্ঞানেরও একটি বিষয়।
আবার অনেকে স্বপ্ন না দেখেও বলে এটা আমার স্বপ্ন ছিল। অথবা আমার জীবনের স্বপ্ন এ রকম ছিল না। মানে, মনের আশা, পরিকল্পনা। তাই স্বপ্নের অর্থ এখানে রূপক।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে এসেছে ইসলাম। এই ইসলাম মানুষের স্বপ্নের ব্যাপারেও উদাসীন থাকেনি। স্বপ্ন সম্পর্কে তার একটি নিজস্ব বক্তব্য আছে। তার এ বক্তব্য কোনো দার্শনিক বা বিজ্ঞানীর বক্তব্যের সাথে মিলে যাবে, এমনটি জরুরী নয়। মিলে গেলেও কোনো দোষ নেই।
স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন রহ. বলেছেন : স্বপ্ন তিন ধরনের হয়ে থাকে। মনের কল্পনা ও অভিজ্ঞতা। শয়তানের ভয় প্রদর্শন ও কুমন্ত্রণা ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সুসংবাদ। (বর্ণনায় : বুখারী)


ইসলামে স্বপ্নের একটি গুরুত্ব আছে। নি:সন্দেহে এটা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এক চোখা বস্তুবাদীরা বলে থাকে, ‍‍‍‍‍‍মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তার মস্তিস্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে। তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিস্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে।‌‌”
কথাটা শুনতে মন্দ নয়। তবে এটি স্বপ্নের একটি প্রকার মাত্র। বাকী দু প্রকার কি আপনাদের মস্তিস্কে ধরা পড়ে? ইসলাম তো বলে স্বপ্ন তিন প্রকার।
হাদীসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন। প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, গত রাতে তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ?
আল-কোরআনে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন, ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নের কথা উল্লেখ আছে। ইউসূফ আলাইহিস সালামের সময়ে মিশরের বাদশার স্বপ্ন, তাঁর জেলখানার সঙ্গীদের স্বপ্ন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বপ্ন নিয়ে তো আল কোরআনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
মিশরের বাদশা তার সভাসদের স্বপ্ন বিশেষজ্ঞদেরকে নিজ স্বপ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। জানতে চেয়েছিল, সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা। তারা বলেছিল, এটা এলোমেলো অলীক স্বপ্ন। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারল না।
নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। নিজের পক্ষ থেকে নয়। আল্লাহ তাআলার শিখানো ইলম থেকে। (সূরা ইউসূফের ৩৬ থেকে ৪৯ আয়াত দ্রষ্টব্য)
আমি বক্ষমান বইতে কোরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার কিছু মৌলিক ধারনা দেয়ার চেষ্টা করব। তবে কি স্বপ্ন দেখলে কি হয়, তা এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে না । এটা নির্দিষ্ট করে আলোচনা করা সম্ভবও নয়। মানে এটা বাজারে প্রচলিত কোনো খাবনামা নয়। স্বপ্ন সম্পর্কে মৌলিক কিছু আলোচনা ও একটি ধারনা দেয়ার প্রয়াস মাত্র।

স্বপ্ন দ্রষ্টার অবস্থা ভেদে একই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হতে পারে।
স্বপ্ন তিন প্রকার:
এক. মনে মনে যা সারাদিন কল্পনা করে তার প্রভাবে ঘুমের মধ্যে ভাল-মন্দ কিছু দেখা। এগুলো আরবীতে আদগাছু আহলাম বা অলীক স্বপ্ন বলে।
দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে স্বপ্ন দেখা। সাধারণত এ সকল স্বপ্ন ভীতিকর হয়ে থাকে।
তিন. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইশারা, ইঙ্গিত হিসাবে স্বপ্ন দেখা।

বিষয়টি উপরে বর্ণিত হাদীসেও উল্লেখ হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাটুকু কবুল করুন। বইটিকে পাঠকদের কল্যাণে গ্রহণ করুন। আর আমরা আমাদের সকল পাওনা ও প্রাপ্তি তার কাছেই আশা করি। তিনি মুহসিনদের সৎকর্ম ব্যর্থ হতে দেন না।

-আব্দুল্লাহ শহীদ আ: রহমান
স্বপ্ন সম্পর্কে কিছু কথা
হাদীসে এসেছে : আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, নবুওয়তে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, বাকী আছে কেবল মুবাশশিরাত (সুসংবাদ)। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, মুবাশশিরাত কী? তিনি বললেন: ভাল স্বপ্ন।
(বর্ণনায় : সহীহ বুখারী)

এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:
এক. স্বপ্ন নবুওয়তের একটি অংশ। নবী ও রাসূলদের কাছে জিবরীল যেমন সরাসরি ওহী নিয়ে আসতেন, তেমনি স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূলদের কাছে প্রত্যাদেশ পাঠাতেন।
দুই. মুসলিম জীবনে স্বপ্ন শুধু একটি স্বপ্ন নয়। এটা হতে পারে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে স্বপ্নদ্রষ্টার প্রতি একটি বার্তা।
তিন. আল মুবাশশিরাত অর্থ সুসংবাদ। সঠিক স্বপ্ন যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তা স্বপ্ন দ্রষ্টার জন্য একটি সুসংবাদ।

হাদীসে এসেছে,আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দিন যত যেতে থাকবে, কিয়ামত নিকটে হবে, মুমিনদের স্বপ্নগুলো তত মিথ্যা হতে দূরে থাকবে। ঈমানদারের স্বপ্ন হল নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের একভাগ।
(বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের মধ্যে যে লোক যত বেশী সত্যবাদি হবে তার স্বপ্ন তত বেশী সত্যে পরিণত হবে।

এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. মুমিনের জীবনে স্বপ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেয়ামত যত নিকটে আসবে ঈমানদারের স্বপ্ন তত বেশী সত্য হতে থাকবে।
দুই. ঈমানদারের জীবনে স্বপ্ন এত গুরুত্ব রাখে যে, তাকে নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।
তিন. মানুষ যত বেশী সততা ও সত্যবাদিতার চর্চা করবে সে ততবেশী সত্য স্বপ্ন দেখতে পাবে।
চার. যদি কেউ চায় সে সত্য স্বপ্ন দেখেব, সে যেন সৎ, সততা ও সত্যবাদিতার সাথে জীবন যাপন করে।

হাদীসে এসেছে,আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে নিদ্রার মধ্যে আমাকে দেখে সে যেন বাস্তবেই আমাকে দেখেছে। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না।
(বুখারী ও মুসলিম)

এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখবে সে সত্যিকারভাবেই তাকে দেখেছে।
দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে। শয়তান মানুষকে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখাতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আকৃতি ধরে ধোকা দিতে পারে না।
তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখা একটি সৌভাগ্য। খুব কম ঈমানদারই আছেন, যারা এ সৌভাগ্যটি অর্জন করেছেন।

স্বপ্ন দেখলে করণীয়
হাদীসে এসেছে, আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন: তোমাদের কেউ যদি এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে, তাহলে জানবে যে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে। তখন সে যেন আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে ও অন্যদের কাছে বর্ণনা করে।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, এ স্বপ্নের কথা শুধু তাকে বলবে, যে তাকে ভালোবাসে।
আর যদি স্বপ্ন অপছন্দের হয়, তাহলে বুঝে নেবে এটা শয়তানের পক্ষ থেকে হয়েছে। তখন সে শয়তানের ক্ষতি থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে আর এ স্বপ্নের কথা কারো কাছে বলবে না। কারণ খারাপ স্বপ্ন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
(বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)

এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. যা কিছু ভাল স্বপ্ন, সেটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবের কারণে দেখে থাকে।
দুই. ভাল স্বপ্ন দেখলে এমন ব্যক্তির কাছে বলা যাবে, যে তাকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসে না, এমন ব্যক্তির কাছে কোনো স্বপ্নের কথা বলা যাবে না। হতে পারে সে ভাল স্বপ্নটির একটি খারাপ ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেবে।
তিন. ভাল স্বপ্ন দেখলে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করতে হবে।
চার. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে বলা উচিত নয়।
পাঁচ. খারাপ স্বপ্ন দেখলে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়া মাত্র আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বলতে হবে আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম।

হাদীসে এসেছে :আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। কেউ স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখলে বাম পাশে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে আর শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ( এভাবে বলবে, আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) তাহলে এ স্বপ্ন তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।
(বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)

এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।
দুই. খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে এসে থাকে।
তিন. খারাপ স্বপ্ন দেখলে সাথে সাথে তিনবার বাম দিকে থুথু ফেলে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানের রাজীম বলতে হবে। তবে সত্যিকার থুথু ফেলবে না। মানে মুখ থেকে পানি নির্গত হবে না। শুধু আওয়াজ করবে। কেননা হাদীসে নাফাস শব্দ এসেছে। যার অর্থ এমন হাল্কা থুথু যাতে পানি বা শ্লেষ্মা নেই।
চার. এই আমলটা করলে খারাপ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।

হাদীসে এসেছে; জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যদি তোমাদের কেউ এমন স্বপ্ন দেখে যা সে পছন্দ করে না, তাহলে তিনবার বাম দিকে থুথু দেবে। আর তিন বার শয়তান থেকে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাবে। (আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলবে) আর যে পার্শ্বে শুয়েছিল, তা পরিবর্তন করবে। (অর্থাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে শুবে)
(বর্ণনায় : মুসলিম)

হাদীস থেকে আমরা শিখতে পারলাম :
এক. খারাপ স্বপ্ন দেখলে তিনবার বাম দিকে থুথু নিক্ষেপ করা ও তিনবার আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলা তারপর পার্শ্ব পরিবর্তন করে শোয়া সুন্নাত।
দুই. পার্শ্ব পরিবর্তন করা মানে হল, ডান কাতে শুয়ে থাকলে বাম দিকে ফিরবে। তেমনি বাম কাতে শুয়ে থাকলে ডানে ফিরবে।

মিথ্যা স্বপ্নের কথা বলা অন্যায়
হাদীসে এসেছে ,আবুল আছকা ওয়াসেলা ইবনুল আছকা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সবচেয়ে বড় মিথ্যা হল, কোনো ব্যক্তি তার নিজের পিতা ব্যতীত অন্যের সন্তান বলে দাবী করা। যে স্বপ্ন সে দেখেনি তা বর্ণনা করা আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেননি তা তাঁর ব্যপারে বলা।
(বর্ণনায় : সহীহ বুখারী)

হাদীস থেকে আমরা শিখতে পারলাম:
সবচয়ে বড় মিথ্যা হল তিনটি,
(ক) নিজের পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা বলে দাবী করা।
(খ) যে স্বপ্ন দেখেনি তা বানিয়ে বলা। অর্থ্যাৎ মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করা।
(গ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি, তা তার কথা বলে চালিয়ে দেয়া।
যারা মিথ্যা স্বপ্ন বর্ণনা করে আর মনে করে, এতে এমন কি ক্ষতি? তাদের জন্য এ হাদীস একটি সাবধান বাণী। এটাকে ছোট পাপ বলে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
সব ধরনের মিথ্যা-ই অন্যায়। এমনকি হাসি ঠাট্টা করে মিথ্যা বলাও পাপ। তবে মিথ্যার মধ্যে এ তিনটি হল খুবই মারাত্মক।
যে পিতা নয় তাকে পিতা বলে লেখা বা ঘোষণা দেয়া এমন অন্যায় যার মাধ্যমে পরিবার প্রথা ও বংশের উপর আঘাত আসে। আর মাতা-পিতার অবদানকে অস্বীকার করা হয়।
কেউ মিথ্যা স্বপ্নের বর্ণনা দিলে তার ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। আর যদি ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে তা সংঘটিত হয়ে যায়।

উদাহরণ : এক ব্যক্তি ইমাম ইবনে সীরিন রহ. এর কাছে এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমার হাতে যেন একটি কাঁচের পেয়ালা। সেটি ভেঙ্গে গেল কিন্তু তার পানি রয়ে গেছে। ইবনে সীরিন রহ. বললেন, তুমি কিন্তু এ রকম কোনো স্বপ্ন দেখোনি। লোকটি রাগ হয়ে বলল, সুবহানাল্লাহ! (আমি মিথ্যে বলিনি)
ইবনে সীরিন রহ. বললেন, যদি স্বপ্ন মিথ্যা হয়, তাহলে আমাকে দোষারোপ করতে পারবে না।
আর এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা হল, তোমার স্ত্রী মারা যাবে আর পেটের বাচ্চাটি জীবিত থাকবে।
এ কথা শোনার পর লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আমি আসলে কোনো স্বপ্ন দেখিনি।
এর কিছুক্ষণ পর তার একটি সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে এবং তাতে আর স্ত্রী মারা গেছে।
(ইমাম জাহাবী রহ. প্রণীত সীয়ার আল-আলাম আন নুবালা)


আরেকটি উদাহরণ:
এক ব্যক্তি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর কাছে এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি, জমিন তরু-তাজা সবুজ হয়েছে। এরপর আবার শুকিয়ে গেছে। আবার সবুজ-তরুতাজা হয়েছে, আবার শুকিয়ে গেছে।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এর ব্যাখা হল তুমি প্রথমে মুমিন থাকবে পরে কাফের হয়ে যাবে। আমার মুমিন হবে, এরপর আবার কাফের হয়ে যাবে আর কাফের অবস্থায় তুমি মৃত্যু বরণ করবে।
এ কথা শুনে লোকটি বলল, আসলে আমি এ রকম কোনো স্বপ্ন দেখিনি। ওমর বাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন :
যে বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করেছিলে তার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।
তোমার বিষয়ে ফয়সালা হয়ে গেছে যেমন ফয়সালা হয়েছিল, ইউসূফ আলাইহিস সালামের সাথীর ব্যাপারে।
(মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, বর্ণনার সনদ সহীহ)
তাই কখনো কাল্পনিক বা মিথ্যা স্বপ্ন বলা ও তার ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া ঠিক নয়।
ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে
হাদীসে এসেছে,আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ভাল ও সুন্দর স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। যদি কেউ ভাল স্বপ্ন দেখে তাহলে তা শুধু তাকেই বলবে যে তাকে ভালোবাসে। অন্য কাউকে বলবে না।
আর যদি স্বপ্নে খারাপ কিছু দেখে তাহলে শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করবে। ( বলবে, আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) এবং বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ করবে। আর কারো কাছে স্বপ্নের কথা বলবে না। মনে রাখবে এ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না।
(বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)


এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।
দুই. খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে এসে থাকে।
তিন. খারাপ স্বপ্ন দেখলে সাথে সাথে তিনবার বাম দিকে থুথু ফেলে আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম বলতে হবে। তবে সত্যিকার থুথু ফেলবে না। মানে মুখ থেকে পানি নির্গত হবে না। শুধু আওয়ায করবে। কেননা হাদীসে নাফাস শব্দ এসেছে। যার অর্থ এমন হাল্কা থুথু যাতে পানি বা শ্লেষ্মা নেই।
চার. এই আমলটুকু করলে খারাপ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না।
পাঁচ. খারাপ স্বপ্ন দেখলে কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না।
ছয়. ভাল স্বপ্ন দেখলে তার কাছেই বর্ণনা করবে যে তাকে ভালোবাসে। শত্রু ভাবাপন্ন বা হিংসুক ধরনের কারো কাছে ভাল স্বপ্নও বর্ণনা করতে নেই। কারণ, হতে পারে ভাল স্বপ্নটির একটি খারাপ ব্যাখ্যা সে শুনিয়ে দেবে। ফলে অস্থিরতা, দু:চিন্তা ও উদ্বেগ বেড়ে যাবে।
দেখুন ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্ন দেখেছিলেন: যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলল, হে আমার পিতা, আমি দেখেছি এগারটি নক্ষত্র, সূর্য ও চাঁদকে, আমি দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়।’সে বলল, হে আমার পুত্র, তুমি তোমার ভাইদের নিকট তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিও না, তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন।’(সূরা ইউসুফ, আয়াত ৪-৫)
এ আয়াতে আমরা দেখলাম ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্ন দেখে তার পিতাকে বর্ণনা করলেন। আর পিতা আল্লাহ তাআলার নবী ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাকে স্বপ্নের কথা নিজ ভাইদের বলতে নিষেধ করলেন। কারণ, ভাইয়েরা তাকে ভালোবাসত না। বরং হিংসা করত।

কয়েকটি ভাল স্বপ্নের উদাহরণ
আল্লাহ তাআলা বলেন: যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মধ্যে তাদেরকে কম সংখ্যায় দেখিয়েছিলেন। আর তোমাকে যদি তিনি তাদেরকে বেশি সংখ্যায় দেখাতেন, তাহলে অবশ্যই তোমরা সাহসহারা হয়ে পড়তে এবং বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করতে। কিন্তু আল্লাহ নিরাপত্তা দিয়েছেন। নিশ্চয় অন্তরে যা আছে তিনি সে সব বিষয়ে অবগত।
(সূরা আনফাল : ৪৩)
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ তাআলা তার রাসূলকে বিজয় লাভের সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তাকে শত্রু বাহিনীর সংখ্যা অনেক কম করে দেখিয়েছেন। বেশি করে দেখালে তিনি হয়ত ভয় পেয়ে যেতেন।
তাই এটি একটি ভাল স্বপ্ন।
এভাবে আল্লাহ তাআলা স্বপ্নের মাধ্যমে তার নবী ও রাসূলদের কাছে ওহী প্রেরণ করতেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন : অবশ্যই আল্লাহ তাঁর রাসূলের স্বপ্নকে যথাযথভাবে সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন। তোমরা ইনশাআল্লাহ নিরাপদে তোমাদের মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে নির্ভয়ে মসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ জেনেছেন যা তোমরা জানতে না। সুতরাং এ ছাড়াও তিনি দিলেন এক নিকটবর্তী বিজয়। (সূরা ফাতাহ : ২৭)
আয়াত থেকে আমরা জানতে পারলাম, আল্লাহ তাআলার তাঁর রাসূলকে মক্কা জয় করার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। আর সে স্বপ্ন আল্লাহ তাআলাই বাস্তবায়ন করেছিলেন।
এমনিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কোরআনে মিশরের বাদশার স্বপ্ন বর্ণনা করেছেন। সে স্বপ্নের সুন্দর ব্যাখ্যা করেছিলেন, নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম। বিষয়টি আল কোরআনের সূরা ইউসুফের ৪৩ আয়াত থেকে ৫৫ আয়াত পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে এবং সেখানে সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে।
এর আগে সূরার ৩৬ আয়াত থেকে ৪২ আয়াত পর্যন্ত ইউসুফ আলাইহিস সালামের জেল জীবনের দুজন সাথীর স্বপ্ন ও ইউসুফ আলাইহিস সালাম কর্তৃক তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি বিষয় তা আল-কোরআনে নবী ইউসুফের ভাষায় বলা হয়েছে এভাবে: হে আমার রব, আপনি আমাকে রাজত্ব দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিখিয়েছেন। হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা! দুনিয়া ও আখিরাতে আপনিই আমার অভিভাবক, আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দিন এবং নেককারদের সাথে আমাকে যুক্ত করে দিন” (সূরা ইউসুফ : ১০১)
এমনিভাবে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ ইবনে আব্দে রাব্বিহী ও ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা স্বপ্নে আজান দেখেছিলেন। আর তাদের স্বপ্নে দেখা আজান-কেই নামাজের বর্তমান আজান ও ইকামত হিসাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো এভাবেই ইসলামের নিদর্শন হিসাবে বাস্তবে রূপ লাভ করেছে অনন্তকালের জন্য।
আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, ভালো ও সুন্দর স্বপ্নগুলো কখনো হুবহু বাস্তব রূপে দেখা যায় আবার কখনো রূপকভাবে ভিন্ন আকৃতিতে ।
যেমন আজান দেয়ার পদ্ধতি সংক্রান্ত স্বপ্ন হুবহু দেখানো হয়েছে। অপরদিকে ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নগুলো ভিন্ন আকৃতিতে রূপকভাবে দেখানো হয়েছে।
Leave a Comment