আজ পবিত্র শবে বরাত। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এটি ভাগ্য নির্ধারণের রাত। বরকতময় এই রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ও দয়া বর্ষিত হয়। এই রাতে ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে পরিশুদ্ধ জীবনযাপনের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা যায়।
ইসলাম ধর্মে শবে বরাতকে চারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রজনীর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এ রাতে আল্লাহ পরবর্তী বছরের জন্য মানবজাতির রিজিক ও সবার ভাগ্য নির্ধারণ করেন এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সব পাপ ক্ষমা করে দেন। এ রাতেই যারা পরবর্তী বছরে জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণ করবে, তাদের তালিকা করা হয়। এ কারণেই রাতটি মুসলমানদের কাছে ভাগ্য নির্ধারণের রজনী হিসেবে বিবেচিত। এ রাতে মুসলমানেরা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে; যারা রিজিক অনুসন্ধানকারী, তারা প্রার্থনা করবে রিজিকের জন্য। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করবে বিপদগ্রস্ত মানুষ। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকতে মুসলমানদের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন রহমত ও দয়ার ভান্ডার। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এটি উৎসবের রাতও।
ধর্মীয় দিকের পাশাপাশি ঐতিহ্যগতভাবে এ উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় মুসলিম সম্প্রদায়। তারা সাধ্যমতো ভালো খাবার তৈরি করে এবং প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণের মাধ্যমে এর আনন্দটুকু ভাগ করে নেয়। তবে ভালো খাবারদাবারের এ আয়োজন কারও কারও কাছে লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যা শবে বরাতের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। লোক দেখানো এসব আয়োজনের চেয়ে এই রাতে গরিব-দুঃখীদের দান-খয়রাত করা এবং তাদের জন্য কিছু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা উত্তম কাজ হিসেবে বিবেচিত।
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পবিত্র এই রাতে পটকা ও আতশবাজি পোড়ানোর যে রেওয়াজ একসময় গড়ে উঠেছিল, তা এখন আর নেই। তবে এ ধরনের কাজ একেবারে বন্ধ হয়েছে, এমনটি বলা যাবে না। পটকা বা আতশবাজি পোড়ানোর বিষয়টি এ রাতের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যকে যেমন নষ্ট করে, তেমনি যাঁরা রাতব্যাপী প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন, তাঁদের ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যাঘাত ঘটায়। পরিবারের ছোটরা যাতে এ ধরনের কাজ করতে না পারে, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সজাগ থাকতে হবে, যাতে কেউ পবিত্র এই রাতের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করতে না পারে।
আমাদের সমাজ যেমন সন্ত্রাস, অস্থিরতা ও হানাহানিমুক্ত হতে পারেনি, তেমনি এসব কারণে এখন সারা বিশ্বে মানুষের জীবন সংকটময় হয়ে উঠেছে। নিজের জন্য প্রার্থনার পাশাপাশি আমরা দেশ ও বিশ্বমানবতার মঙ্গলেও সর্বশক্তিমান আল্লাহর করুণা প্রার্থনা করব। এই রাতের কল্যাণে সবার আগামী দিনগুলো সুন্দর ও মঙ্গলময় হয়ে উঠুক।
শবে-বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
আমরা সকলে জানি মুসলান ধর্মালম্বীদের কাছে শবে বরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু অনেকে বলে শবে বরাত পালন করা যায়েয নয় বা পালন করা ঠিক নয়। এই সম্পর্কে আমার কাছে সংরক্ষিত একটা দলিল তুলে ধরলাম।পবিত্র ক্বোরআন মাজীদের ২৬ তম পারায় সূরা 'দুখানা' এর ৩নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, "ইহা আমি অবেতীর্ণ করেছি এক মোবারক রজনীতে, অবশ্যই আমি শতর্ককারী। এই রজনীতে আমার আদেশক্রমে প্রত্যক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত।"
মুফাসিরিনে কেরামগণ আলোচ্য আয়াতকে 'বরকতময় রাত বলতে শবে-বরাত এবং শবে ক্বদর উভয় রাতকেই গ্রহণ করেছেন।
আমার কাছে কয়েকটি বড় বড় ব্যাখ্যা আছে যেগুলো লিখতে অনেক সময় লাগবে। তাই আমি সংক্ষেপে দু-একটি উল্লেখ করছি,
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী তানবী (রহ:) তাঁর বিখ্যাত উর্দু তাফসীর 'বয়ানুল কুরআনে'-এ আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে 'লাইলাতুল মুবারাকাহ' বলতে গিয়ে বলেন, "কেউ কেউ লাইলাতুল মুবারাকাহ এর ব্যাখ্যা লাইলাতুল বরাত করেছেন। এর কারণ এই যে, বিভিন্ন বর্ণনায় এ সম্পর্কেও বার্ষিক ঘটনাবলীর সিদ্ধান্তের বিষয় এসেছে।" (পৃষ্টা:৯৯, ২য় খন্ড)
শবে বরাতের পরিচয়:
আরবি শাবান মাসের চৌদ্দই দিবাগত পঁনের তারিখের রাতকে 'শবে বরাত' বলা হয়। এই রাতে একটি বছরের জন্য সৃষ্টি জগতের অদৃষ্ট বন্টন করা হয়। এই জন্য এই রাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এই কারণেই সাবান মাসের ফজিলত অনেক বেশি।
তাৎপর্য:
এই রাত্রি সম্পর্কে হযরত মোহাম্মদ (সা:) বলেন, এই রাত্রিতে এবাদত-কারিদের গুনাহরাশি আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করে দেন। তবে কেবল আল্লাহর সাথে শিরককারী, সুদখোর,গণক, যাদুকর, কৃপণ, শরাবী, যিনাকারী এবং পিতা-মাতাকে কষ্টদানকারীকে আল্লাহ মাফ করবেন না।
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে হুজুর (সা:) বলেছেন, "জিব্রাইল (আ:) আমাকে বলেছেন, আপনি আপনার উম্মতদের জানাইয়া দেন যে, তারা যেন শবে বরাতের রাতকে জিবীত রাখে।" অর্থাত্, সারারাত তারা যেন ইবাদতের মাঝে কাটাইয়া দেয়।
আরেকটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেছেন,এই রাত্রে আসমান থেকে ৭০ লক্ষ ফেরেশতা যমীনে আসিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া এবাদতকারী-দিগকে পরিদর্শন করেন এবং তাদের এবাতদ সমূহ দেখতে থাকেন।
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যাক্তি সাবান চাঁদের পঁনের তারিখে রাতে এবাদত করবে এবং দিনে রোজা রাখবে, দোজখের আগুন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
আরো এক হাদিসে রাসূল (সা:) বলেছেন, তোমরা শবে বরাতকে সম্মানিত মনে কর। এটা শাবান চাঁদের পঁনের তারিখের রাত্রি। এই রাত্রে যারা এবাদতে মগ্ন থাকে তাদের প্রতি আল্লাহ পাকের রহমতের ফেরেশাতাগণ আবতীর্ণ হয়। আর আল্লাহ তাদের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন।
এক হাদীসে এসেছে নবী কারীম (সা:) বলেছেন, এই রাতে আল্লাহ তা'আলা মোমিন মুসলমাদিগকে ডাকিয়া বলেন, আজ আমার যে বান্দা মার্জনা কামনা করবে, আমি তাকে মার্জনা করে দেব। যে বান্দা সাস্থ্য কামনা করবে, তাকে সাস্থ্য দান করব। যে বান্দা ধনৈশ্ব্-র্যের কামনা করবে, তাকে ঐশ্বর্যশালী করে দিব।
শবে বরাতের রাতে করণীয়:
এই রাত্রের সূচনাতেই অর্থাত্ সূর্যাস্তকালে গোসল করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। অত:পর মাগরিবের নামাজ পড়ে বিভিন্ন তাসবি-তাহলীল পাঠ করলে অনেক সওয়াব পাওয়া যায়। তারপর এশার নামাজ পড়ে (বিতরের নামাজ বাকী রেখে) দুই রাকাত নিয়তে নফল নামাজ পড়তে পারেন। কিছুক্ষণ পর পর দোয়া করবেন। দরুদ শরীফ পড়বেন, ক্বোরআন তিলাওয়াত করবেন। বেশি বেশি করে কাজ্বা নামাগুলো আদায় করবেন। এভাবেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলেই শবেবরাতের পূর্ণ ফজিলত পাওয়া যাবে। [ফজরের আগেই বিতরের নামাজ আদায় করতে হবে]
This entry was posted on Saturday, July 16, 2011 at 10:51 PM and is filed under পবিত্র রজনি,পবিত্র শবে বরাত. You can follow any responses to this entry through the RSS 2.0 feed. You can leave a response.